শাহরিয়ার কবীর: ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস করার সুযোগ বাংলাদেশের চলে গেছে। এখন ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণতহ্যা দিবস পালন করা হয়। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এটি নিয়ে দেশের ভেতও এবং বাইরে ১৫ বছর লড়াই করেছি। সরকার তখন এর প্রতি কোনো কর্ণপাত করেননি। ২০১৫ সালে ৯ ডিসেম্বরকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণা করেছে এবং সেখানে বাংলাদেশ উপস্থিত ছিলো। আমরা এখন দেশ ও দেশের বাইরে প্রচার করছি ১৯৭১ সালের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যা দিবস পালনের কোনো সুযোগ বাংলাদেশের সামনে এখন নেই। আমাদের বাঙালিরা যারা বিদেশে আছে তারা পালন করতে পারে। কিন্তু জাতিসংঘের মাধ্যমে ২৫ মার্চের স্বীকৃতি পাওয়া যাবে না। কারণ সেই সুযোগ বাংলাদেশ হারিয়েছে।
বহুবার আমরা জাতিসংঘে গেছি তারা তখনই জানতে চেয়েছে যে বাংলাদেশ সরকার এ দিবস করেন কিনা? তখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার এ দিবস পালন করেনি। আমাদের ৩০ বছরের দাবির কারণে ২০১৭ সালে জাতীয় গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হলো ২৫ মার্চ। তারপর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার কোনো দেশকে একটি চিঠি পর্যন্ত দেয়নি যে বাংলাদেশে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই। সুতরাং এখানে সরকারের সদিচ্ছার বা উদ্যোগের অভাব আছে।
আমরা এখন যেটা ঘোষণা করেছি- বাংলাদেশে ৩০ লাখ শহীদ হয়েছে, আমরা ৩০ লাখ গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করবো বাংলাদেশেসহ সরা পৃথিবী থেকে। তারপর জাতিসংঘ এবং জাতিসংঘের সদস্যদের বলবো আমাদের নয় মাসের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। সেখানেও সরকারের সহযোগিতা লাগবে। সরকার সহযোগিতা না করলে আমরা অন্য দেশের সরকারের কাছে পৌঁছতে পারবো না। যেসব দেশে আমরা আবেদন করবো, চিঠি দেবো সেসব দেশে পার্লামেন্টে একটা করতে হবে এই মর্মে। সেটা সরকারের অনুরোধ ছাড়া আমাদের কথায় কোনো দেশ করবে না। সুতরাং সরকার এবং নাগরিক সমাজ আমরা সবাই উদ্যোগ নিলে একাত্তরের গণহত্যার একটা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া যেতে পারে।
তবে সেটাও বহু বছর লাগবে, কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এটা ২১ ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মতো এতো সহজ নয়। কারণ একাত্তরের গণহত্যার সময় পাকিস্তানের পক্ষে আমেরিকা, চীন, মুসলিম উম্মাহ, পশ্চিম ইউরোপ ছিলো। বলতে গেলে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশই পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো। তারা তো এতো সহজে এটা মানবে না। যদি না সেসব দেশে আমরা জনমত তৈরি করতে না পারি। সেখানে সরকারকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করতে হবে আমাদের মতো উদ্যোগগুলোকে।
পঁচাত্তরের পর থেকে বেশির ভাগ সময় ধরে এখানে স্বাধীনতাবিরোধী ও গণহত্যাকারীরাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষমতায় ছিলো। এখন তো সরকার তাদের তোয়াজ করছে। একমাত্র ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ৩০ বছর ধরে এই গণহত্যার কথা বলছে। কিছু রচনা আছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরেরও। কিন্তু সরকারিভাবে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে একটা বই প্রকাশ করা হয়নি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যার পরিসংখ্যান নিয়ে সরকারি ভাষ্য নেই। মুক্তিযুদ্ধের সরকারি একটা ইতিহাস নেই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর একটা সরকারি জীবনী নেই। প্রামাণ্য জীবনী যেটা সরকার লেখতে পারে। শস্য দানা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি বানিয়ে গিনেজ বুকে নাম তোলানোর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই বিষয়গুলো তরুণ প্রজন্মকে জানানো।
এরকম ভয়াভহ গণহত্যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর কোথাও হয়নি। আমরা যদি আমাদের শত্রু না চিনি, মুক্তিযুদ্ধের জন্য কতোবড় ত্যাগ করে আমাদের পূর্ব প্রজন্ম সেটা না জানলে আমরা কী করে দেশকে ভালোবাসবো। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার জায়গা থাকবে কী করে। পাঠ্যপুস্তকে একাত্তরের গণহত্যার কোনো বয়ান নেই। জামায়াতে ইসলামী আলবদর গঠন করেছে বলে তাদের নাম কেটে দেওয়া হয়েছে। আলবদর বাহিনী, জামায়াত ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার কথা পাঠ্যপোস্তকে নেই। তরুণ প্রজন্ম জানবে কোথা থেকে? পঁচিশ মার্চ সরকার ও প্রধানমন্ত্রী একটা বিবৃতি দেবে, এটা যথেষ্ট নয়। মুক্তিযুদ্ধকে জানাতে গেলে পাঠ্যপুস্তকে এই বিষয়গুলোকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। এটা সাধারণ পাঠ্যপুস্তক, মাদ্রাসা, ইংরেজি মাধ্যমসহ সর্বত্র এটা তরুণ প্রজন্মকে জানাতে হবে। সরকারি প্রচার মাধ্যমে এগুলো নিয়মিত প্রচার করতে হবে।
বিটিভি থেকে শুরু করে সব গণমাধ্যমের তরুণ প্রজন্মকে আলোকিত করার বহু উপায় আছে। প্রামাণ্য চিত্র বানানো যায়, বই লেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডাটা ব্যাংক তৈরি করা যায়। বহু কিছু কারা যায়। আমরা আমাদের সীমিত সক্ষমতা অনুযায়ী করে যাচ্ছি। গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কেন দরকার এই নিয়ে আমাদের বাংলা, ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষায় প্রচুর লেখা এখনো বের হচ্ছে। আমাদের জাগরণ মুখপত্র ৯টি ভাষায় বের হয়। সেখানে আরবি, ফারসি, হিন্দি ও তার্কি ভাষাতে গণহত্যার কথা তুলে ধরছি। কিন্তু সরকারি উদ্যোগ তেমন নেই।
পরিচিতি : সভাপতি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমিরুল ইসলাম।