এম আমির হোসেন : নারী ও পুরুষ একই প্রজাতির হলেও একই জেন্ডারের নয়। এই সত্যটি ভুলে যাই আমরা। একই মানব প্রজাতি হওয়ার জন্য যেমন কমন কিছু বৈশিষ্ট্য ও অধিকার আছে, তদ্রুপ ভিন্ন জেন্ডার হওয়ার কারণে ভিন্ন কিছু বৈশিষ্ট্য এবং ভিন্ন অধিকারও আছে। এগুলোকে সম্মান করা ও নিশ্চিত করাই সভ্য সমাজের কাজ। ‘পুরুষ’-কে স্ট্যান্ডার্ড ধরে নারীকে পুরুষের মতো হতে চাওয়ার ভাবনা প্রকারান্তরে পুরুষকে ‘উন্নত জেন্ডার’ ভাবার হীনম্মন্যতা থেকেই আসে। কোনো জেন্ডারই উন্নত নয়, বরং প্রজাতির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক মাত্র। বিশেষ কিছু কাজের ক্ষেত্রে নারীর দক্ষতা বিকাশের সুযোগ যেমন আছে, তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুযোগ আছে পুরুষেরও। এই ক্ষেত্রগুলোকে নিরাপদ করাই সভ্য সমাজের দায়িত্ব। জেন্ডার ভিন্নতার কারণে নারী ও পুরুষের যে ভিন্নতা তা বৈষম্যের জন্য নয়, বৈচিত্রের জন্য। এই বৈচিত্রে শ্রেষ্ঠত্বের কিছু নেই, আছে পরিপূরকতা। এই বৈচিত্র্য সুন্দরের জন্য। একে রক্ষা ও সম্মান-করা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার দায়িত্ব। একটা জনপ্রিয় ব্যাখ্যা আছে বটে;- সমাজ নারীদের এমন বানিয়ে রেখেছে, তেমন বানিয়ে রেখেছে, দমিয়ে রেখেছে, এগুতে দেয়নি ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো আংশিক সত্য হলেও পুরো সত্য নয়। নারী হলো ব্যক্তি, নারীত্ব হলো ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিত্ব গঠনে সামাজিক প্রভাবের পাশাপাশি জেনেটিক-হরমোনাল-মানসিক প্রভাবও কম নয়। ‘অতি নারীত্ব’ যে কোনো ‘অতি’-র মতোই মন্দ ও কপটতা প্রসূত। নারীত্ব গঠনে সামাজিক ব্যাখ্যাটি নিয়েই বেশি আলোচনা হয়, কিন্তু জেনেটিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করতে চায় না। নারীর চরিত্র ও স্বভাবে জেনেটিক-হরমোনাল যে প্রভাব তা অস্বীকার করার ভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক নয়।
বায়োলজিক্যাল বিষয়গুলো পরিবর্তন করা না গেলেও সামাজিক বিষয়গুলো ঠিকই সংস্কার করা যায়। তবে সেই সংস্কার-কার্যক্রম বায়োলজিক্যাল সত্যকে ভুলে গিয়ে করলে তা কখনো ফলপ্রসূ হবে না-এটা নিশ্চিত। যে অঞ্চলে আইনের শাসনের অভাব প্রচণ্ড, বিদ্যমান আইনেরও নেই সুষম প্রয়োগ, আইনভঙ্গকারীরা রাজনৈতিক ছায়াতলে আশ্রয় পায়, সঙ্গত কারণেই সেখানে অন্যান্য দুর্বলপক্ষের মতো নারীরাও হয় ভালনারেবল গ্রুপ। নিরাপত্তা নারীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। প্রচলিত সমাজ কাঠামো ও সংস্কার ভেঙ্গে গেলে নারীর পথচলা আরও অনিরাপদ হয়ে উঠবে-এই ভাবনা তাকে ভীত করে। এ জন্য অনেক নারী পুরুষের চেয়েও অধিক পুরুষবাদী হয়ে ওঠে; হয়ে উঠে সংস্কার বিরোধী। হয়ে উঠে পুরুষতন্ত্রের সুযোগ্যা ‘নারী প্রতিনিধি’। নারী মানব প্রজাতির ফিমেল জেন্ডারের সদস্য মাত্র। তাকে মহীয়সী, মমতাময়ী ইত্যাদি বিশেষণ দেওয়া অতি-মূল্যায়ণ ও উদ্দেশ্যমূলক; পাশাপাশি ছলনাময়ী বা কুলটা বলাও অবমূল্যায়ন; এবং সেটাও উদ্দেশ্যমূলক। মানুষ হওয়ার পথে নারীকে দমিয়ে রাখার জন্য এগুলো পুরুষতান্ত্রিক প্রণোদনা ও অপকৌশল ছাড়া আর কিছু নয়। নারী দিবস এলে নারীদের নিয়ে নানান স্তুতিবাক্য শোনা যায়। প্রায়োগিক বিদ্যায় তাদের সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়েছে সত্য। অনেক নারী-ডাক্তার, নারী-আমলা, নারী-প্রকৌশলী দেখা যায় এখন। কিন্তু মৌলিক বিদ্যায় তারা বেশ পিছিয়ে আছে। যেমন নারী-বিজ্ঞানী, নারী-দার্শনিক খুব বিরল। পৃথিবীর প্রধান ধর্মগুলোর কোনো শীর্ষ প্রচারক নারী নেই। কেন? এই সত্যগুলো স্তুতিবাক্যের মালা দিয়ে না ঢেকে নির্মোহ ও বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। পৃথিবীর অর্ধেক মস্তিষ্কের পটেনশিয়াল পরিপূর্ণ ব্যবহার ছাড়া মানব সভ্যতার প্রকৃত উন্নয়ন কি সম্ভব? মৌলিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞায়ও নারীরা এগিয়ে যাক- নারী দিবসে এই প্রত্যাশা আমার। লেখক : চিকিৎসক