শেখ মিরাজুল ইসলাম: ফেব্রুয়ারি মাস এলে আমরা ভাষার ব্যবহার নিয়ে প্রচুর ভালো ভালো কথা বলি। আশার কথা, ঈদানীং যুক্ত হয়েছে আদিবাসী ভাষাগুলোর যথাযথ সংরক্ষণের তাগিদমূলক প্রচারণা। একই সঙ্গে আমরা স্বীকার করে নিয়েছি প্রত্যেকের নিজ নিজ মাতৃভাষা চর্চার অধিকার রক্ষা করা প্রয়োজন। সর্বক্ষেত্রে বাংলার প্রচলনে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা সরকারি মারফতে ক্রমাগত প্রচার করলেও মাস শেষে তা নিছক বুলিতে পর্যবসিত হবার পেছনের উৎস কেউ খুঁজতে যায় না। কেবলমাত্র অফিস, পথ-ঘাট বা দোকানের ব্যানার-সাইনবোর্ডে বাংলা হরফ লিখলেই ভাষার সংস্কার সাধন হয় না।
সে ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা আগামী প্রজন্মের মস্তিষ্কের কোষে স্থায়ী করবার মূল কাজটি হতে পারে আমাদের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। কিন্তু শ্রেণি বৈষম্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সেখানে ঠিকই চালু আছে ভাষা বৈষম্য। কাগজে কলমে যাই থাকুক, বাস্তবে চলছে বাংলা বনাম ইংরেজি মাধ্যমের অঘোষিত দ্বন্দ্ব। ‘স্কুলিং সিস্টেমে’ ভাষা চর্চার বৈষম্য নিয়ে প্রচুর কথাবার্তা শুনি আমরা। তবে এটা সত্য, প্রত্যেক অভিভাবক চান সুশিক্ষার পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, আধুনিকতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সহপাঠী আর সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের যথাযথ সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজ নিজ সন্তানকে পড়ালেখা করাতে।
সে ক্ষেত্রে তাদের প্রথম পছন্দ ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। পাশাপাশি সন্তানের শিক্ষার ক্ষেত্রে ভাষার মাধ্যম হিসেবে তাদের অগ্রাধিকার থাকে অবশ্যই ইংরেজিতে। বিষয়টি ঘিরে অভিভাবক মহলে প্রতিযোগিতা ইঁদুর দৌড়ের চেয়েও বেশি। ভালো স্কুল বলতে এখন বোঝায় ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা দেওয়ার যোগ্যতাকে। তাই ওখানে ব্যবসাটাও ভালো চলে। ভালো জিনিসের দাম বেশি বলে কেউ প্রশ্নও করেন না। কিন্তু শেষ বিচারে ‘স্কুলিং’ অধ্যায় শেষ করে শিক্ষা জীবনের শেষ পর্যায়ে সন্তান কোথায় থিতু হলো তার হিসেব হয় ভিন্ন।
বর্তমান প্রজন্মের অভিভাবকরা বুঝে গেছেন কর্পোরেট জগতে ভালো ইংরেজি জানার প্রয়োজন আছে। শুধু তাই নয়, আরও দুই তিনটি ভাষা জানাও জরুরি। তাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যেন গড়ে উঠছে কর্পোরেট যুগকে উপজীব্য করে। অথচ বাস্তবতায় দেখা যায়, গ্রাম ও মফস্বলের স্কুলে বাংলা মাধ্যমের শিশুরাই পরবর্তী সময়ে নেতা, উদ্যোক্তা, মন্ত্রী বা এমপি হয়। বেশি বেতনের ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা হয় তাদের গড়া প্রতিষ্ঠানের বেতনভুক কর্মচারী-কর্মকর্তা।
এর কারণ বিশ্লেষণে দেখা যাবে প্রায় প্রতিটি গ্রামের স্কুলের সামনে ছোট আকারের হলেও খোলা একটা খেলার মাঠ আছে। সেখানে তারা দৌড়ায়, খামচাখামচি করে, মারামারি করে একজন আরেকজনের জামার বোতাম ছিঁড়ে দেয়। শিক্ষক কালেভদ্রে দৌড়ে এসে কখনো বাচ্চাদের মারামারি মিটিয়ে দেন। কখনো গায়ে আঁচড়ের দাগ নিয়ে বাচ্চারা বাবা-মাকে নালিশ দেয় কিংবা দেয় না। এই শিক্ষাটা ভবিষ্যতে তাদের কঠিন জীবনে কাজে লাগে।
তাদের মধ্যে কেউ কেউ অনেকে শাসন করতে শেখে, সহজাত নেতৃত্ব গুণের অধিকারী হয়। যদিও কথাটা অতি সরলীকরণ, কিন্তু তা বাস্তবতাবর্জিত নয়। এর উল্টো পিঠে, সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষা প্রকারান্তে ইংরেজি ভাষাকে শাসন করলেও চাকরির বাজারে ইংরেজি চর্চাকে পরাস্ত করতে পারে না আমাদের মাতৃভাষা। এমন কুহেলিকা ও ধাঁধাঁ প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের বিবিধ প্রশ্নের সম্মুখীন করে। নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে সাধারণ আলাপে আমরা এই প্রশ্নে বিতর্ক করি, তত্ত্বিক আলাপে সময় অপচয় করি। কিন্তু তারপরও সারা বছর এই ভাষা- বৈষম্যের সমাধান খুঁজে পাই না। চিকিৎসক ও লেখক
আপনার মতামত লিখুন :