স্বপন দেব: আখাউড়া-সিলেটের রেললাইন জড়াজীর্ণ দশার কারণে এ রেলপথে ঘটছে ঘন ঘন রেলদুর্ঘটনা। এ রেল সেকশনে দূর্ঘটনা যেন নিত্য সঙ্গী যাত্রীদের। দুর্ঘটনা থেকে কোনভাবেই রেহাই পাচ্ছেন না সিলেটের যাত্রীরা। ঢাকা ও চট্টগ্রাম পথে চলাচলকারী যাত্রীদের প্রশ্ন আর কতবড় রেলদুর্ঘটনা ঘটলে রেল বিভাগের টনক নড়বে? বিগত ৬ মাসে এ সেকশনে ৭টি ট্রেন দুঘর্টনা ঘটেছে। সবশেষ বৃহস্পতিবার গভীর রাত সাড়ে ১২টায় ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও এর নিকটে তেলবাহী ট্রেনের ১০টি বগি লাইনচ্যুত হওয়ায় সিলেটের ট্রেনযাত্রীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।
প্রতিটি রেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পর শুরু হয় কিছু তোড়জোড়। চলে ঘটনার নানা মাত্রিক তদন্ত এরপর যেই সেই। রেল মন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সিলেটে অঞ্চলে নতুন লাইন তৈরির বিশাল প্রকল্প নেয়া হয়েছে কিন্তু কার্যত কোন পদক্ষেপই চোখে পড়ছেনা। যদিও কিছু ট্রেনে নতুন ট্রেনের বগি সংযোজন করা হয়েছে তা সত্বেও ট্রেন দুর্ঘটনার হার যেন কিছুতেই কমছে না।
কুলাউড়া রেলওয়ে জংশন স্টেশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সহকারি মাস্টার জানান , সিলেট আখাউড়া সেকশনের রেললাইন ব্রিটিশ আমলের তৈরি। দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে রেললাইন ও ব্রিজগুলোও মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গত ৬ মাসে এ সিলেট সেকশনে শ্রীমঙ্গল, সাতগাঁও, ভানুগাছ, কুলাউড়া ও ফেঞ্চুগঞ্জ এলাকায় ৭টি দুর্ঘটনা ঘটেছে।
২০১৯ সালের জুনে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচালে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যান চার যাত্রী ও আহত হন শতাধিক। প্রতিবছর সিলেট-আখাউড়া রেলপথে ১৫-২০টি ছোট ছোট দুর্ঘটনা ঘটছে। ২০২০ সালে দীর্ঘদিন করোনার কারণে রেল চলাচল বন্ধ থাকলেও সে বছরের আগস্ট থেকে চালু হওয়ার পর থেকে চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তেলবাহী ট্রেনসহ ৭টি ট্রেন দুর্ঘটনাকবলিত হয়।
গত ৬ ডিসেম্বর দুপুরে মাধবপুরের শাহাজীবাজার রেলস্টেশনের পাশে তেলবাহী ট্রেনের পাঁচটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। এ কারণে ১৩ ঘণ্টা সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকে। ১১ নভেম্বর কুলাউড়ার ভাটেরায় মালবাহী ট্রেনের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। এতে বন্ধ হয়ে পড়ে সিলেটের সাথে সারাদেশের রেল যোগাযোগ। ৭ নভেম্বর সাতটি বগি নিয়ে শ্রীমঙ্গলে তেলবাহী একটি ওয়াগন লাইনচ্যুত হয়। এতে রেল যোগাযোগ ২৩ ঘণ্টা বন্ধ থাকে। একই স্থানে ২০১৮ সালে ১১টি বগি নিয়ে একটি যাত্রীবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। চলতি বছরের ৩০ অক্টোবর সিলেট রেলস্টেশনে ডকইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়িকা এক্সপ্রেসের সামনের দিকে ধাক্কা দেয় জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও এলাকায় গত ১৫ সেপ্টেম্বর তেলবাহী ওয়াগনের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়। ২৩ আগস্ট যাত্রীবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয় কুলাউড়া এলাকায়। একই স্টেশনে গত ২৪ জানুয়ারীর ট্রেনের বগিতে আগুন ধরে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে এ রুটে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটে গত বছরের ২৩ জুন। ওই দিন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচাল এলাকায় উপবন এক্সপ্রেসের পাঁচটি বগি সেতু ভেঙে ছড়ায় পড়ে যায়। এতে চারজন নিহত ও শতাধিক যাত্রী আহত হন। ২১ ঘণ্টা পর রেল চলাচল স্বাভাবিক হয়।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ১৭৯ কিলোমিটার আখাউড়া-সিলেট রেলপথের পুরোটাই জরাজীর্ণ। এই সেকশনে ৯০ শতাংশ সেতুই মেয়াদোত্তীর্ণ। তার মধ্যে এই রুটের সব ট্রেনের বগি-ইঞ্জিন অনেক পুরনো। বর্তমানে কিছুটা ভালো মানের বগি ব্যবহৃত হচ্ছে।
কুলাউড়া স্টেশনে যাত্রী শফিক আহমদ বলেন, সিলেট লাইনে আর কত দুর্ঘটনা ঘটলে রেললাইন মেরামত করা হবে। নতুন ইঞ্জিন সংযোজন করলেই হবে না, সেবার মান ও যাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
সিলেট স্টেশনের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পাহাড়ি ও আঁকাবাঁকা সড়ক হওয়ায় আখাউড়া-সিলেট সেকশনের রশিদপুর থেকে মাইজগাঁও পর্যন্ত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। আখাউড়া-সিলেট রেলপথে পারাবত, জয়ন্তিকা, পাহাড়িকা, উদয়ন, উপবন ও কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনে প্রতিদিন ১৪-১৫ হাজার যাত্রী সিলেট-ঢাকা ও সিলেট-চট্টগ্রামে যাতায়াত করেন। নির্মাণের ৫৫ বছর পর রেল সেতুর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এ রুটের সেতুর বয়স প্রায় শত বছরের কাছাকাছি। তালিকা অনুযায়ী ১৩টি সেতুকে ‘ডেড স্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ সেতুর আগে ট্রেন থেমে যাবে, পরে ৫ কিলোমিটার গতিতে সেতু অতিক্রম করবে। সিলেট থেকে মোগলাবাজার স্টেশন পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে ৮টি ও মোগলাবাজার থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ১৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে ৫টি সেতু ‘ডেড স্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সিলেট-আখাউড়া রেল সেকশনে আগে ট্রেন চলত ঘণ্টায় ৭০-৮০ কিলোমিটার গতিতে। এখন তা অর্ধেকে নামিয়ে ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার করা হয়েছে। ফলে এ রেলপথে সকল ট্রেনের যাত্রাকাল বেশি লাগছে। আর যাত্রীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গন্তব্যে চলাচল করতে হচ্ছে। এ দূর্ভোগের কি শেষ নেই?