দীপক চৌধুরী: স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশের বিদ্যমান নানাবিধ সমস্যার মধ্যে একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে দুর্নীতি। যে সমাজে দুর্নীতি একটা ‘সর্বগ্রাসী’ রূপ ধারণ করেছে, সেখানে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ উচ্চারণ ভীষণ সাহসের ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রী শুধু আশ্বাসই দিচ্ছেন না বরং কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাবে এ সরকার।’ এটা হবে বর্তমান সরকারের একটা অন্যতম প্রধান কাজ। এটা চ্যালেঞ্জও বটে। বঙ্গবন্ধুকন্যার এ আশ্বাস এক ধরনের স্বীকৃতিও যে, আমরা এ ধরনের আশ্বাসে বিশ্বাস রাখতে চাই। কিন্তু নানা প্রশ্ন আজ সামনে। দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন বিএনপির মুখে দুর্নীতি নিয়ে মন্তব্য হাস্যকর। সম্প্রতি এমন একটি মন্তব্য করেছেন আমাদের তথ্যমন্ত্রীও। সৎসাহসী রাজনীতিজ্ঞ ডক্টর হাছান মাহমুদ সত্যিটা বুক ফুলিয়ে বলতে জানেন, জাতির স্বার্থে সত্যকথা উচ্চারণ করতে হবেই। সাংবাদিকতার ছয়ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, অনেকে সত্য কথা বলতেই চান না। তাঁরা দল করেন, দলের বড় পদও দখলে রাখেন। কিন্তু বাস্তবতার মুখে চুপসে যান। স্পষ্টবাদী হতে পারেন না, কারো কারো ‘সুবিধাবাদী চরিত্র’ বড় বেশি পীড়াদায়ক। চোখের সম্মুখে দেখা যায়, দুর্নীতি সংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকর্মীদের নাজেহাল হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এতে দুর্নীতিবাজরা উৎসাহিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে অর্থ ও মানব পাচারের মামলায় কুয়েতের আদালতে লক্ষ্মীপুরের সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের অর্থদণ্ডসহ চার বছর জেল হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। সর্বোচ্চ রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির পরও কেন দেশে দুর্নীতির বিস্তার রোধে কঠিন হওয়া যাচ্ছে না- এমন প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। অবশ্য, এটি নিয়ে আমাদের সকলেরই ভাবা জরুরি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন। দেশটি আমাদের। কিন্তু ডানে-বায়ে কিছু ব্যক্তির এমন কিছু কথা শুনতে হয় যা হাস্যকর। যদিও এ জাতীয় কথার জবাব দিতে গিয়ে তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নদের মুখে দুর্নীতি নিয়ে মন্তব্য হাস্যকর। সম্প্রতি রাজধানীর শাহবাগে কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান মিলনায়তনে ১৪তম আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসব উদ্বোধনে প্রধান অতিথির বক্তব্য শেষে সাংবাদিকদের এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা বলেন। বিশেষ অতিথি সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এসময় উপস্থিত ছিলেন। এটা এখন আর অজানা নয় যে, সম্প্রতি কুয়েতের একটি আদালতে মানব ও অর্থ পাচারের মামলায় লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য শহিদ ইসলাম পাপুল’র সাজা হওয়ার পর বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভীর মন্তব্য ‘পাপুলের সাজায় আওয়ামী লীগের দুর্নীতি আজ বিশ্বস্বীকৃত’ এর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ড. হাছান বলেন, ‘বিএনপির দুর্নীতির কারণে তাদের আমলে দেশ পরপর পাঁচবার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। যাদের আমলে দেশ পরপর চারবার একক ও একবার যুগ্মভাবে দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়, তাদের মুখে দুর্নীতি নিয়ে মন্তব্য হাস্যকর।’ তাঁর মতে, ‘আর পাপুল একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য। তার দুর্নীতির দায় কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের ওপর বর্তায় না’। তিনি বলেন, ‘কুয়েতের আদালতে তার সাজা হয়েছে, বাংলাদেশেও দুদক এবিষয়ে তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদ করছে।’
জিরো টলারেন্স কথাটি বাংলাদেশে এখন জনপ্রিয় হলেও আগে কেউ কখনো সাহস করে এমন অর্থবহ শব্দ উচ্চারণ করেননি। আমরা সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা শুনেছি কেবল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠেই, আর কারো কণ্ঠে নয়। আমাদের মনে আছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, মন্ত্রী-সচিবেরা সৎ হলে ৫০ শতাংশ দুর্নীতি কমে যাবে। এর পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেওয়া তাঁর প্রথম ভাষণে দুর্নীতিগ্রস্তদের ‘শোধরানোর’ আহ্বান জানিয়েছেন। শেখ হাসিনা কতটা বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ তা আমরা জানি। দুর্নীতি উচ্ছেদের সংকল্পের পাশাপাশি তিনি শেষ বারের মতো হুঁশিয়ার করেছেন। আমাদের কতিপয় ‘প্রভাবশালীকে’ শোধরানোর সুযোগ দিয়েছেন। তিনি মানবতার মা। তিনি গণতন্ত্রের সাধক। ১৯৭৫-এ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর এদেশ থেকে গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়। এটি পুন:প্রতিষ্ঠার জন্যই শেখ হাসিনার আপসহীন সংগ্রাম। তিনি উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের লড়াইয়ে শ্রেষ্ঠ, কিংবদন্তি। বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থেই তাঁর এমন মহৎগুণ জাতিকে মনে রাখতে হবে। যদিও আমরা জানি, কতিপয় মানুষের দুর্নীতি নিয়ে রাজনীতি ও সমাজে অস্বস্তি রয়েছে।
আমরা এটাও জানি, বাংলাদেশ জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ। কাজেই দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করে নাগরিকদের জন্য স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকার দায়বদ্ধ। বঙ্গবন্ধুকন্যা এটারই সর্বাত্বক চেষ্টা করছেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, দুর্নীতির সুবিধাভোগীরা অত্যন্ত প্রভাবশালী। রাজনৈতিক শুদ্ধাচারের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত ও দমন করা গেলে আগামী বছরগুলোয় সূচকে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে। টিআইর সূচক অনুযায়ী ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ছিল সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। দুর্নীতিবিরোধী নির্বাচনি অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে বিগত বছরগুলোয় অনেকে ক্ষেত্রে ইতিবাচক উদ্যোগ থাকলেও কার্যকরভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের শতভাগ চেষ্টা সফল হয়নি। এই পরিকল্পনা স্থাপনে সরকারের সদিচ্ছার যথেষ্ট চেষ্টা ছিল এবং আছেও। তবে একদিন শেখ হাসিনা তা করতে সফল হবেন, সেটা অতি সন্নিকটে। তরুণ প্রজন্মের ভরসা তিনি। গৃহহীনকে গৃহদান, ভূমিহীনকে গৃহদান এটা যে বিশে^ই প্রথম। বিশ^ব্যাপী করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক বিদ্যমান। ভ্যাকসিন আদায় এটাও তো সফল কূটনীতি। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রমাণ করেছেন, আমরা পারি এবং পারবো। তবে এ দেশের মানুষের কামনা-বাসনা যাই বলি না কেন, তাদের মনোবাসনা যে, সামনের দিনগুলোতে জাতির পিতার সুযোগ্য জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় থাকতেই হবে।
লেখক : উপসম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি, সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক