দীপক চৌধুরী: বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন আর নেই। উপমহাদেশের আলোচিত ও গুণী শিল্পী হিসেবে সুপরিচিত রাবেয়া খাতুনের অবিরাম চলাচল ছিল সাহিত্যের সকল শাখায়। এমন কোনো সেক্টর ছিলো না যে তিনি বিচরণ করেননি। আমাদের সাহিত্য জগতে ‘ঢাক’ পিটিয়ে অনেকে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চান কিন্তু তিনি নিজেকে জানান দেওয়ার মধ্যে কখনো ছিলেন না। অসাধারণ মেধাবী ও কিংবদন্তি এই কথাসাহিত্যিক নিজেকে গুটিয়ে রাখতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন।
প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা ও কণ্টকাকীর্ণ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারার অসাধারণ যোগ্যতা ছিল তাঁর । বিভিন্ন রচনায় অনুমান করা যায় যে, তিনি মানুষ হিসেবে অসাম্প্রদায়িক ও সাহসী ছিলেন। বাঙলা সাহিত্যকে তিনি করেছেন সমৃদ্ধ। তাঁর রচনায় আমাদের অস্তি¡ত্ব এসেছে। গৌরব এসেছে, ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ করেছি দেশ স্বাধীন করার জন্য তাও এসেছে। এদেশের রাজনীতিতে নানারকম জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৭৫-এ। এটিও তুলে ধরেছেন তিনি তাঁর লেখায়। অত্যন্ত শক্তিধর এই লেখিকার প্রতিটি রচনায় বাঙালির স্বাতন্ত্র্যবাধ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। তাঁর রচনা; সেটি প্রবন্ধ বা ভ্রমণ কাহিনী হোক না কেন- উপন্যাস-গল্পে আমরা খুঁজে পাই স্বাতন্ত্র্যদায়ক চিন্তা ।
পঞ্চাশের দশকে এই অঞ্চলের মুসলিম নারীদের জীবন যখন নানা বিধিনিষেধের বেড়াজালে বন্দী, তেমন সময়ে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন একজন লেখক হিসেবে। কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত হলেও রাবেয়া খাতুন একসময় শিক্ষকতা করেছেন। সাংবাদিকতার সঙ্গেও দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন। ‘সিনেমা’ পত্রিকা ছাড়াও তাঁর সম্পাদনায় পঞ্চাশের দশকে প্রকাশিত হতো ‘অঙ্গনা’ নামে নারীদের একটি মাসিক পত্রিকা।
তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। তিনি দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। রাবেয়া খাতুনের দুই ছেলে ফরিদুর রেজা সাগর এবং ফরহাদুর রেজা প্রবাল বর্তমানে দেশের বাইরে।
রাবেয়া খাতুনের স্বামী প্রয়াত এ টি এম ফজলুল হক ছিলেন দেশের চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রথম পত্রিকা সিনেমার সম্পাদক ও চিত্রপরিচালক। বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘প্রেসিডেন্ট’-এর পরিচালকও তিনি। ১৯৫২ সালের ২৩ জুলাই তাঁদের বিয়ে হয়। রাবেয়া খাতুন রচিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জনপ্রিয় উপন্যাস ‘মেঘের পর মেঘ’ অবলম্বনে একই নামে ২০০৪ সালে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম। যদিও তিনি বহু আগেই প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন তবু ‘মেঘের পরে মেঘ’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাবেয়া খাতুন বাংলা সাহিত্যের এক স্বাতন্ত্র্যধর্মী লেখক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হন। ২০১১ সালে তাঁর আরেক জনপ্রিয় উপন্যাস ‘মধুমতি’ অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন পরিচালক শাহজাহান চৌধুরী। ২০০৩ সালে তাঁর লেখা ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ অবলম্বনে এই নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন অভিনেত্রী মৌসুমী।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি বিশিষ্ট গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ফরিদুর রেজা সাগরের মা।
রাবেয়া খাতুন লিখেছেন উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, কিশোর উপন্যাস, স্মৃতিকথা। তাঁর বহু লেখা থেকে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র ও নাটক। এসব চলচ্চিত্র বা নাটক ভীষণ জনপ্রিয়তা পায়। কারণ এগেুলো ছিল মানুষের মনের গহীনের ভাষা ও বিশ্বাস।
লেখক : উপসম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি, সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক