ফাহমিদুল হক: হেফাজতের ‘মূর্তি’ বনাম আওয়ামী লীগের ‘ভাস্কর্য’। হেফাজতে ইসলাম, তার অনুসারী ও সমমনা ধর্মীয় গোষ্ঠী কিন্তু সব বিষয় নিয়ে কথা বলে না। তাদের এজেন্ডায় কী কী থাকে?
[১] পৌত্তলিকতা: ‘মুসলমান’-এর দেশে কোনো মূর্তি (বা ভাস্কর্য যাই হোক) থাকবে না (১০ শতাংশ অমুসলিমকে তারা গোনায় ধরে না)।
[২] নারী : নারীদের পর্দা করে চলতে হবে (বেশি পড়াশোনা করার দরকার নেই, অত ঘরের বাইরে যাবার দরকার নেই)
[৩] নাস্তিক: নাস্তিকরা মানবজাতির কলঙ্ক, তাদের কতল করা ওয়াজিব।
[৪] আহমদিয়া/কাদিয়ানি: আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে।
[৫] ইত্যাদি...
আসুন আমরা মিলিয়ে দেখি বর্তমান বাংলাদেশের প্রধান সঙ্কটগুলো কী কী?
[১] স্বাস্থ্য: কভিড-১৯ মোকাবেলা করবো কীভাবে?
[২] গণতন্ত্র: গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনা যাবে কীভাবে?
[৩] বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড: গুম-ক্রসফায়ার বন্ধ হবে কীভাবে, কবে?
[৪] দুর্নীতি : অর্থ লুটপাট ও পাচার ঠেকানো যাবে কীভাবে?
[৫] ন্যায়বিচার : সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে কীভাবে?
[৬] সহিংসতা: নারী এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বল জনগোষ্ঠীর (হিন্দু-বৌদ্ধ, আদিবাসী, গরিব ও ক্ষমতাহীন) ওপর সহিংসতা কীভাবে বন্ধ করা যাবে?
[৭] ইত্যাদি...
দুই তালিকায় যদি আমরা মিলিয়ে দেখি, এই ধর্মীয় গোষ্ঠীর বাংলাদেশের চলমান সঙ্কটগুলো নিয়ে কোনো বক্তব্য নেই। তাদের এজেন্ডায় বর্তমান নেই, মানুষ নেই, সুশাসন নেই। আজ থেকে এক দশক আগে, কিংবা এক শতক আগে কিংবা আরও কয়েক শতক আগে, এধরনের ধর্মীয় গোষ্ঠী যা নিয়ে কথা বলতো আজও তা নিয়ে কথা বলে।
বাংলাদেশ তো বটেই, বৈশ্বিক সঙ্কটের বিষয়েও তাদের বিশেষ কিছু চিন্তা নেই (ধরা যাক, কভিড-১৯ বা জলবায়ু পরিবর্তন।)
শাহবাগ-উত্তর রাজনীতিতে বর্তমান সরকার জামায়াতকে রাজনীতি থেকে এক্সক্লুড করার জন্য হেফাজতকে এলাই হিসেবে ইনক্লুড করে। আওয়ামী লীগ সরকার যেহেতু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী নয়, তাই তারা সারাক্ষণ নানান উৎকণ্ঠায় ভোগে, এই বুঝি কোনো শক্তির উত্থান ঘটলো, তাদের সিংহাসন থেকে নামালো। বিবিধ শক্তির মধ্যে এক বড় সম্ভাব্য হুমকি হলো ধর্মীয় গোষ্ঠী, তাইতো চলছে হেফাজততোষণ। বিনিময়ে সরকার ও তাদের (হেফাজত ও অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠী) মধ্যে বেশ কিছু লেনদেন হয় :
[১] রেলওয়ের জমি-জিরাত পায় হেফাজত।
[২] পাঠপুস্তক থেকে হেফাজতের প্রেসক্রিপশন মতো হিন্দু লেখকদের লেখা বাদ যায়, ধর্মনিরপেক্ষ ভাবধারার টেক্সট বাদ যায় এবং কিছু ইসলামী ভাবধারার টেক্সট ঢোকে।
[৩] বইমেলায় পুলিশ বই চেক করে, ‘ইসলামবিরোধী’ কিছু কোথাও ছাপা হচ্ছে কিনা; থেকে থেকে বই নিষিদ্ধ হয়, স্টল বাতিল হয়।
[৪] দাওরায়ে হাদিসকে স্বাতকোত্তর ডিগ্রি স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং এজন্য প্রধানমন্ত্রীকে ‘কওমী জননী’ উপাধি দেওয়া হয় এবং তিনি তা গ্রহণ করেন।
[৫] তাদের দাবির মুখে হাইকোর্টের সামনে থেকে থেমিসের ‘মূর্তি’ অপসারণ করা হয় (কয়েক বছর আগে লালনের ‘মূর্তি’ অপসারণ করা হয়, বিমানবন্দরের সামনে থেকে)।
[৬] ইত্যাদি...
আজ বঙ্গবন্ধুর ‘ভাস্কর্য’ অপসারণের দাবি ওঠায় আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনগুলো এবং তাদের সাংস্কৃতিক ফ্রন্টগুলো কিছুটা নড়াচড়া শুরু করেছে। ব্যাপারটা হলো, সম্পর্ক যেহেতু লেনদেনের, এই ‘মূর্তি’র ট্রাম্পকার্ডটা ফেলা হয়েছে, আরও কিছু পাবার জন্যই। আওয়ামী প্রপাগান্ডা গোষ্ঠী থেকে ‘ভাস্কর্য’ দিয়ে ‘মূর্তি’কে ওভারট্রাম্প করার চেষ্টা চলছে (অবশ্য এর আগে, ওপরের ৫টি বিষয়ে ইনাদের পরিস্কার বক্তব্য শোনা যায়নি)। এলাইদের মধ্যে এই ‘টেনশন’ অবশ্য দেখতে মন্দ নয়। কিন্তু এ হলো দৃশ্যমান খেলা। পর্দার আড়ালে হয়তো অন্য খেলা চলছে। তার ফল কী আসে, তা জানতে আমাদের হয়তো আরও খানিকটা অপেক্ষা করতে হবে। ফেসবুক থেকে