দীপক চৌধুরী: ভাস্কর্য নিয়ে খুব বেশি উত্তাপ ছড়ানো হচ্ছে কয়েকদিন ধরে। আগে যে ‘ভাস্কর্য ইস্যু’ ছিল না তা নয়। কিন্তু এখন মারাত্মক পর্যায়ে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য দেশের স্বাধীনতা ও ইতিহাসের অংশ। এই প্রজন্ম ভাস্কর্য দেখে শিখবে। ইতিহাস জানবে, আমরা কোথায় ছিলাম আর এখন কোথায় পৌঁছেছি তাও। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশটিকে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা এখন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ ছিল একটা নিম্ন আয়ের দরিদ্র দেশ। এই একটা দেশকে এভাবে পরিবর্তন করার নজির বিশ্বের ইতিহাসে নেই। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন দেশের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অথচ তাঁর শাসনামলেই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়- তা কী মেনে নেওয়া যায়! আমি মনে করি, দেশের আওয়ামী লীগ দলীয় প্রত্যেক সংসদ সদস্যের দায়িত্ব হবে নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন করা। প্রত্যেক মন্ত্রীর নির্বাচনি এলাকায় সরকারি বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই ভাস্কর্য নির্মাণ ও স্থাপন করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে ঘিরে আলোচনাসভা করার জন্য নান্দনিক অবকাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন। সেখানে সেমিনার, টক শো, কুইজ, চিত্রাঙ্কন, রচনা, বক্তৃতা, নাটকসহ নানান আয়োজন করা হবে।
ভাস্কর্য মূর্তি কেন হবে? বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে কেউ পূজা করতে যাচ্ছে নাকি? কিন্তু ইসলামপন্থী কিছু নেতা হুমকি দিয়ে বলেছেন, ভাস্কর্য ভেঙে ফেলতে হবে, টেনেছিঁড়ে নামাতে হবে। আশ্চর্য বিষয়, যাঁর নির্দেশে বাংলাদেশ হয়েছে, আমরা যুদ্ধ করেছি, লক্ষ লক্ষ মা-বোন সম্মান ও জীবন বিসর্জন করেছেন, ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে দেশ পেয়েছি আমরা সেই নেতার প্রতি এমন ধৃষ্টতা দেখানো হয় কীভাবে? সবারই মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ। সুতরাং এটাকে নষ্ট করার উদ্যোগ নেওয়ার পরিণতিতে শাস্তি হতে হবে। জনগণ এদের একটু জোরে আওয়াজ দিলেই পালাবার পথ পাবে না। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছে আইনানুগ পথে তাদের শাস্তি দেয়ার বিধান নেই!
এটা ঠিক যে, মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে কোনোভাবে আশকারা দেওয়া ঠিক হবে না। শুধু আশকারা নয়, এদের কঠিনভাবে মোকাবিলা করতে হবে।
সম্প্রতি বিআইডব্লিউটিএ’র নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের ভিআইপি জেটিতে সাংবাদিকদের সাথে এক মতবিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘কোনো অর্বাচীনের কথায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণকাজ বন্ধ করা হবে না। সারা দেশে জাতির পিতার অসংখ্য ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। পথেঘাটে কে কী বলল, তা নিয়ে গুরুত্ব দেয়ার কোনো কারণ নেই।’
কদিন আগে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ইয়েমেন, পাকিস্তানসহ সকল মুসলিম দেশেই তাদের দেশ ও জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য ধারণ করে বহু ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশের ধর্ম ব্যবসায়ীদের ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে অবস্থান আসলে বাংলাদেশ ও বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিরুদ্ধেই অবস্থান। পাকিস্তানপন্থী স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ধর্মভিত্তিক দল ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের আসল টার্গেট সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা।’
একটি চক্র বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে মন্তব্য করে শনিবার শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেছেন, ‘তাদের এই ফাঁদে পা দিয়ে বাংলাদেশকে আফগানিস্তান পাকিস্তানের মতো হতে দেওয়া হবে না। ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতান্ত্রিক যে সমাজের স্বপ্নের ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছিল, তা ভুলুণ্ঠিত হলে কোনো কিছুরই সুফলই মিলবে না।’
লেখক : উপসম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি, সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যক