লুৎফর রহমান রিটন: আমার সুনীলদা
লুৎফর রহমান রিটন: আমার শৈশব-কৈশোর-যৌবনকে রাঙিয়ে দেয়া মানুষদের একজন সুনীলদা আপনি। আমার বিকশিত হবার বাঁকগুলোয় আপনি দাঁড়িয়ে ছিলেন বই হাতে, একজন মহাপরাক্রমশালী সম্রাটের মতো। নিজের ঐশ্বর্য-বৈভবের প্রাচুর্যসমুদ্র থেকে একটার পর একটা বই আপনি তুলে দিয়েছেন আমার হাতে। আমি বেড়ে উঠেছি সুনীলদা আপনার বই পড়তে পড়তে। এই কানাডার প্রবাস জীবনেও আপনি তো আমার সঙ্গেই ছিলেন! এখনও বিছানায় শুয়ে হাত বাড়ালেই উঠে আসে আপনার ‘অর্ধেক জীবন’।
০২
১৯৯৬ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদের উৎসবে আপনি ঢাকায় এলেন। উঠলেন হোয়াইট হাউস-এ। সকালে আপনাকে ফোন করলাম। অপারেটর আপনার রুমে লাইনটা থ্রো করতেই টেলিফোন রিসিভ করলেন কবি বেলাল চৌধুরী। ফোনের এই প্রান্তে আমাকে আবিস্কার করে বেলাল ভাই উত্তেজিত—আরে রিটন তুমি তো ইতিহাস সৃষ্টি করে ফেলেছ! সুনীলদা পাশের কামরার দরোজা বন্ধ করে লিখতে বসেছেন। তোমার ছোটদের কাগজের জন্যে গল্প লিখছেন সুনীলদা। ঢাকায় সুনীলদা বহুবার এসেছেন কিন্তু এমনটা কখনোই হয়নি যে হোটেলে বসে গল্প-টল্প লিখছেন। তুমি খুব লাকি।
‘রোশনি’ নামে একটা তরতাজা গল্প আপনি দিয়েছিলেন বটে কিন্তু আমি তাতে খুশি হতে পারিনি। কথা ছিলো কাকাবাবুকে নিয়ে একটা উপন্যাস দেবেন। অতঃপর আমাকে খুশি করতে বেকায়দায় পড়ে আপনি একটি প্রতিশ্রুতিপত্র লিখে দিইয়েছিলেন।
‘রোশনি’ গল্পটার নিচে আপনার অসাধারণ হস্তাক্ষরে লেখা সেই প্রতিশ্রুতিটি আমি ছেপে দেব বললে আপনি বারণ করেননি।
বলেছিলেন—'তুমি হচ্ছো নাছোড় সম্পাদক। দাও ছেপে। আপনি লিখেছিলেন—‘ছোটদের কাগজের পাঠক বন্ধুরা, তোমাদের জন্যে কাকাবাবুকে নিয়ে পুরো একটা উপন্যাস লিখছি। ‘ছোটদের কাগজ’-এর পরবর্তী কোনো সংখ্যাতে অবশ্যই দেখা হবে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬, ঢাকা।’
০৩
কিন্তু আপনি দেননি আর প্রতিশ্রুত সেই কাকাবাবুর উপন্যাস। আপনার ওপর তাই খুব অভিমান জমতে শুরু করেছিলো। আমার শৈশব-কৈশোর-যৌবনের প্রিয় ছায়াসঙ্গীর নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। গোপন ভালোবাসার নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আনন্দ আর বিষাদের নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে শুধুই ভালোবাসা যায়। তাঁর সঙ্গে অভিমান করা যায় খানিকটা ঝগড়াও করা যায় কিন্তু রাগ তো করা যায় না! কারণ আপনি তো আমার সুনীল দা। আমার শৈশব-কৈশোর ও যৌবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ। আমার যাপিত জীবনের দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনীর আনন্দ-বেদনা আর বিষাদ-নিঃসঙ্গতার মিথষ্ক্রিয়ায় রচিত আটপৌড়ে চিত্রকল্পের অপরূপ এক নির্মাতা।
০৪
১৯৯৮ সালের ২৫ অক্টোবর সকালে ঢাকার শান্তিনগরের হোয়াইট হাউজে আপনার সঙ্গে দেখা। আমার সম্পাদিত ছোটদের কাগজের জন্যে একটা চটজলদি সাক্ষাৎকার নিতেই সেখানে আমার যাওয়া। (সেবার আপনার সঙ্গে কবি জয় গোস্বামীও ছিলেন।)
সে বছর ফেব্রুয়ারি মাসে বেরিয়েছিলো আমার 'ছড়াসমস্ত' নামের সমগ্রটি। ছড়ার সমগ্রের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সেটাই ছিলো প্রথম অভিযাত্রা। একটা কপি নিয়ে গিয়েছিলাম আপনাকে দেবো বলে। 'ছড়াসমস্ত' বইটার নাম এবং প্রোডাকশন দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন আপনি। বলেছিলাম--অন্নদাশঙ্কর রায়ের ছড়াসমগ্র বেরিয়েছে অনেক আগে। এদিকে আমারও একটা ছড়া সমগ্র বেরুলো গেলো ফেব্রুয়ারিতে। তারপর গত পরশু কবি শামসুর রাহমানেরও একটা ছড়াসমগ্র বেরুলো। অর্থাৎ ছড়ার ক্ষেত্রে আমরা সমগ্র পেয়েছি মাত্র তিনটি।
আমার ছড়াসমস্তর পাতা উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন আপনি এভাবে(ছোটদের কাগজ নভেম্বর-ডিসেম্বর ১৯৯৮ সংখ্যা থেকে উদ্ধৃত করি)--'তোমার যে 'ছড়াসমস্ত' বেরিয়েছে, দেখলাম আমি বইটা। যেমন দেখতে সুন্দর হয়েছে, লেখাগুলো তো খুবই ভালো। লেখাগুলো তো আগেই পড়েছি। তুমি তো রিটন ইতিহাসে স্থান পেয়ে গেলে! মাত্র তিনজনের মধ্যে তুমি একজন! তা-ও আবার দ্বিতীয়জনই তুমি!'
সেদিন, ১৯৯৮ সালের ২৫ অক্টোবর, আপনার সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম যখন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রিবন্ধু নাসির আলী মামুন আমাদের কয়েকটা ছবি তুলেছিলেন। তার মধ্যে দু'টো ছবির একটিতে আপনি খুব আগ্রহ নিয়ে ছড়াসমস্ত বইটা দেখছেন।
দ্বিতীয় ছবিটায় একটা মাইক্রো ক্যাসেট রেকর্ডারে আমি আপনার সাক্ষাৎকার নিচ্ছি।
বাইশ বছর পর, আজ ২০২০ সালের আরেক অক্টোবরে, অক্টোবরের ২৩ তারিখে, আপনার চলে যাবার দিনে বিষণ্ণ আমি স্মৃতির য়্যালবাম খুলে মামুনের তোলা সেই ছবিদু'টোই দেখছি বারবার। আমার সুনীলদা ছবির মানুষ হয়ে গেছেন!
ভালো থাকবেন সুনীলদা।
আপনার সঙ্গে আবারো নিশ্চয়ই দেখা হবে আমার, অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে।
[আলোকচিত্র/ নাসির আলী মামুন, ১৯৯৮]
ফেসবুক থেকে