ডেস্ক রিপোর্ট: প্রশাসন ক্যাডারে পদের চেয়ে বেশি কর্মকর্তা কাজ করছেন। পদ না থাকার পরও কর্মকর্তাদের পদোন্নতি হচ্ছে। পাশাপাশি অন্যান্য ক্যাডারে পুরোপুরি উল্টো চিত্র। শিক্ষা ক্যাডারে পদ খালি থাকার পরও পদোন্নতি হচ্ছে না। খাদ্যসহ অন্যান্য ক্যাডারে শূন্য পদ না থাকার কথা বলে যোগ্যদের পদোন্নতি বঞ্চিত করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তারা বলছেন, বিভিন্ন ক্যাডারের প্রতি ভিন্ন ভিন্ন নীতির কারণে দক্ষ পেশাজীবী গড়ে তোলার উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না সরকারের।
প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক কর্মকর্তা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘সব ক্যাডারের বিষয়েই সমান আন্তরিক হতে হবে। প্রয়োজন আছে বলেই এত ক্যাডার সৃষ্টি করা হয়েছে। কাজেই কোনো একটি বিশেষ ক্যাডার দুর্বল হলে ওই সেক্টরটিই দুর্বল হয়ে পড়বে, যা কারও কাম্য নয়।’
গত ২৬ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে কর্মরত ৯৮ জন যুগ্ম সচিবকে পদোন্নতি দিয়ে অতিরিক্ত সচিব করা হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদে অনুমোদিত পদের সংখ্যা ২১২। গত বছর ৭৫ শতাংশ বাড়িয়ে অতিরিক্ত সচিবের পদ ২১২টিতে উন্নীত করা হয়। ৯৮ জনকে এ পদে পদোন্নতি দেওয়ার পর অনুমোদিত পদের চেয়ে বাড়তি অতিরিক্ত সচিবের সংখ্যা দাঁড়াল ৩৫৬। পদ না থাকায় পদোন্নতি পাওয়া অধিকাংশ কর্মকর্তাকে আগের পদেই কাজ করতে হচ্ছে অথবা ওএসডি থাকতে হচ্ছে।
পদের চেয়ে অতিরিক্ত কর্মকর্তা শুধু অতিরিক্ত সচিব পদেই নয়, উপসচিব এবং যুগ্ম সচিব পদেও রয়েছেন। গত বছর ৩১ শতাংশ বাড়িয়ে যুগ্ম সচিবের পদ করা হয়েছে ৫০২টি। পদ বৃদ্ধির পরও যুগ্ম সচিব পদে অতিরিক্ত কর্মকর্তা কাজ করছেন। বর্তমানে যুগ্ম সচিব রয়েছেন ৭৪৯ জন।
২০১৭ সালে উপসচিবের পদ ছিল ১ হাজার ৩২৪টি। বর্তমানে উপসচিবের পদ ১ হাজার ৭৫০টি। উপসচিবের পদ বেড়েছে ৩২ শতাংশ। বর্তমানে উপসচিব রয়েছেন ১ হাজার ৬৩৩ জন। শিগগিরই সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতি হবে। এ ক্ষেত্রে ২৭তম ব্যাচকে পদোন্নতি দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে দুই শতাধিক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হবেন বিভিন্ন ব্যাচের লেফটআউট (পদোন্নতি বঞ্চিত) কর্মকর্তারা। সব মিলিয়ে এ সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়ে যাবে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ফুড ক্যাডারের এন্ট্রি পদ হচ্ছে সহকারী খাদ্য নিয়ন্ত্রক (এসি ফুড)। এ পদের সংখ্যা ৬৯টি। অথচ এ পদে কর্মরত ক্যাডার কর্মকর্তার সংখ্যা মাত্র ১৭ জন। ক্যাডার কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালন করছেন নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা। সারা দেশে ১৩টি সেন্ট্রাল স্টোরেজ ডিপো (সিএসডি) রয়েছে। এসব পদে এসি ফুডদের পদায়ন পাওয়ার কথা। কিন্তু এ পদে দায়িত্ব পালন করছেন নন-ক্যাডার উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকরা। এসি ফুড থেকে পদোন্নতি পেয়ে হয় ডিসি ফুড বা সমমানের কর্মকর্তা, যা ষষ্ঠ গ্রেডের পদ। ডিসি ফুডের পদ সংখ্যা ১০৫টি। অথচ এ পদে কর্মরত ক্যাডার কর্মকর্তা মাত্র ৩০ জন। চলতি দায়িত্ব বা অতিরিক্ত দায়িত্বের মাধ্যমে জোড়াতালি দিয়ে এসব পদের কাজ চালিয়ে নেওয়া হয়। আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের পদ ১৩টি। এর ওপরের পদ পরিচালক। তৃতীয় গ্রেডের এই পদের সংখ্যা ৭টি। এর ওপরের পদ দ্বিতীয় গ্রেডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক। এই ক্যাডারের গ্রেড ওয়ান পদ হচ্ছে মহাপরিচালক।
ফুড ক্যাডারের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন প্রতি ক্যাডারে একটি করে পদ থাকবে গ্রেড ওয়ানের। ফুড ক্যাডারেও গ্রেড ওয়ান পদ রয়েছে। তবে ওই পদে রয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। আমাদের ক্যাডার কর্মকর্তাদের নানা অজুহাতে মহাপরিচালক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয় না। বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটি (ডিপিসি) সময়মতো আমাদের বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে না। এই ডিপিসির দায়িত্বেও থাকেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তারা ফুড ক্যাডারকে ল্যাংড়া-লুলা বানিয়ে রাখেন, যাতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা অনায়াসে সেখানে প্রেষণে নিয়োগ পেতে পারেন।’
দেশের সরকারি কলেজগুলোর মধ্যে যেগুলোতে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নেই সেই তালিকা চেয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। জরুরি ভিত্তিতে এই তালিকা আগামীকালের মধ্যে দেওয়ার জন্য মাউশির ৯ জন আঞ্চলিক পরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার আঞ্চলিক পরিচালকদের কাছে এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠিয়েছে মাউশি। শূন্য পদগুলোতে নিয়োগ দেওয়ার জন্য এই তালিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বেশ কিছুদিন ধরেই অনেক সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ নেই। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিয়ে চালানো হচ্ছে এসব কলেজ। নিয়মিত অধ্যক্ষ না থাকায় শিক্ষা ও প্রশাসনিক নানা কাজ বিঘিœত হচ্ছে। তাদের দিয়ে কোনো রকমে দৈনন্দিন কাজ চলছে। দেশের ৬৩২টি সরকারি কলেজের মধ্যে ৮৫টি কলেজের অধ্যক্ষ পদ ফাঁকা। শুধু অধ্যক্ষ নয়, উপাধ্যক্ষের ২৬ পদও শূন্য।
অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষরা প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকেন। যারা শিক্ষার্থীদের পাঠদান করান, সেই শিক্ষকের পদও ফাঁকা। বড় শহরের বড় কয়েকটি কলেজ ছাড়া বেশিরভাগ সরকারি কলেজেই শিক্ষক সংকট রয়েছে।
সাধারণত অধ্যাপকদের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। দেশের সরকারি কলেজে অধ্যাপক পদ ৫২৮টি। অধ্যাপকের শূন্য পদ ১৮১টি। আর সহযোগী অধ্যাপক পদ ২ হাজার ২৬১টি। এর মধ্যে শূন্য পদ ৯৫৮টি। সহকারী অধ্যাপক ৪ হাজার ৩৬৮টি। সহকারী অধ্যাপকের শূন্য পদ ৩৭১টি। শিক্ষা ক্যাডারের এন্ট্রি পদ হচ্ছে প্রভাষক। এই পদের সংখ্যা ৮ হাজার ৯৪টি। এর এক-চতুর্থাংশ পদই শূন্য। প্র্রভাষক পদ শূন্য আছে ২ হাজার ৪১টি।
শিক্ষা ক্যাডারের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কাম্য সংখ্যক পদ সৃজন না হওয়ায় সব যোগ্যতা থাকার পরও পদোন্নতি দেওয়া যায় না। ৩টি তৃতীয় গ্রেড পদ সৃজনের প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে এবং ১২ হাজার ৫১৯টি পদ সৃজনের প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।’
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সদস্য সচিব অধ্যাপক শাহেদুল কবীর চৌধুরী বলেন, ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন ক্যাডারে নবম গ্রেড থেকে ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষেত্রে পদোন্নতি যোগ্যদের সহজেই পদোন্নতি দেওয়া হয়। কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারের ক্ষেত্রে শূন্য পদের কথা বলে যোগ্যদের পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়। আবার অন্যান্য ক্যাডারে পঞ্চম গ্রেড থেকে তৃতীয় গ্রেডে পদোন্নতি দেওয়া হলেও শিক্ষা ক্যাডারে পঞ্চম গ্রেড থেকে চতুর্থ গ্রেডে পদোন্নতি দেওয়ার ফলে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। শিক্ষার পদের যে বিন্যাস তা আশির দশকে নির্ধারিত। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিগ্রি, অনার্স বা মাস্টার্স থাকলে পদ বিন্যাস কী হবে, তা এনাম কমিশনের পর কেউই সংস্কার করেনি। বছর বছর বিভিন্ন কলেজে যে হারে অনার্স ও মাস্টার্স খোলা হচ্ছে, পদ সেভাবে বাড়ানো হয়নি। এই সংকট বা অচলাবস্থাটি চার দশকের।’
মাউশির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রশাসন ক্যাডারের যখন পদ বাড়াতে হয়, তখন এত কিছু লাগে না, দ্রুত হয়ে যায়। যখন অন্য ক্যাডারের বিষয় আসে, তখনই নানা প্রসঙ্গ আসে। আমরা জনপ্রশাসনের কুয়েরি (জিজ্ঞাসা) মিট আপ (পূরণ) করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। সব ধরনের কুয়েরি মিটআপ করার পরও জনপ্রশাসনে পড়ে থাকে।’
সমবায় সরকারের একটি ছোট ক্যাডার। আশির দশকে যে কয়েকটি পদ নিয়ে ক্যাডারটি যাত্রা শুরু করেছিল, এখনো সেই পদই রয়েছে। বিসিএস পাস করে সমবায় ক্যাডারের কর্মকর্তাদের উপজেলা পর্যায়ের পদ বা প্রারম্ভিক পদ অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার হিসেবে কাজ শুরু করার কথা। কিন্তু তারা কাজ শুরু করেন জেলা পর্যায়ের পদ ডেপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে। অর্থাৎ এখন অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার দিয়ে ডেপুটি রেজিস্ট্রারের কাজ চালানো হচ্ছে। কর্মকর্তারা চাকরিতে ঢুকেই জেলা পর্যায়ে কাজ করছেন। সমবায় বিভাগ এই সমস্যা সমাধানের জন্য ১৫ বছর আগে নতুন পদ সৃষ্টির প্রস্তাব পাঠায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। এখনো সেই প্রস্তাব ঝুলেই আছে বলে সমবায় ক্যাডারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ইনফরমেশন অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুন্সী জালাল উদ্দিন বলেন, ‘সমমর্যাদার কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈষম্য বাড়িয়ে দিয়েছে গাড়ি সুবিধা। এছাড়া অন্যান্য ক্যাডারে পদ শূন্য থাকা সাপেক্ষে পদোন্নতি দেওয়া হয়। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারে পদোন্নতি দিতে পদ শূন্য থাকার দরকার হয় না। বৃহত্তর স্বার্থে এই বৈষম্যের অবসান হওয়া দরকার।’ দেশ রূপান্তর