শিরোনাম
◈ ত্রিশালে বাসের ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত ◈ জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজ মুক্ত করার বিষয়ে  সরকার অনেক দূর এগিয়েছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী  ◈ এসএসসি পরীক্ষায় আমূল পরিবর্তন, বদলে যেতে পারে পরীক্ষার নামও ◈ পঞ্চম দিনের মতো কর্মবিরতিতে ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ◈ অর্থাভাবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে লড়বেন না ভারতের অর্থমন্ত্রী ◈ কখন কাকে ধরে নিয়ে যায় কোনো নিশ্চয়তা নেই: ফখরুল ◈ জনপ্রিয়তায় ট্রাম্পের কাছাকাছি বাইডেন ◈ আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নতুন তারিখ ৮ মে ◈ সেনা গোয়েন্দাসংস্থার বিরুদ্ধে ৬ পাক বিচারপতির ভয় দেখানোর অভিযোগ ◈ নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিরা সাদা পতাকা উড়াচ্ছিল, তাদের বূলডোজার দিয়ে মাটি চাপা দিল ইসরায়েলী সেনারা

প্রকাশিত : ০৩ অক্টোবর, ২০২০, ০৯:৫৮ সকাল
আপডেট : ০৩ অক্টোবর, ২০২০, ০৯:৫৮ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

হারিয়ে যাওয়া মাছ ফিরছে খাবার টেবিলে

ডেস্ক রিপোর্ট: স্বাদুপানির ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৬৪ প্রজাতির মাছ এখন বিলুপ্ত হওয়ার পথে। ইতোমধ্যে গবেষণার মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় ২৪ প্রজাতির মাছ আবার খাবার টেবিলে ফিরেছে। বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজাতির সংরক্ষণ, প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে বিগত ৩৫ বছরে মাছের উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে পাঁচ গুণের বেশি। এ বছর মাছের উৎপাদন হয়েছে ৪৩ লাখ ৮৪ হাজার মেট্রিক টন। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য দেশজুড়ে ৫৩৪টি অভয়াশ্রম স্থাপন করা হয়েছে। সম্প্রতি বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণের জন্য মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পুকুরে ‘লাইভ জিন ব্যাংক’ উদ্বোধন করা হয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিএফআরআই মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, এই লাইভ জিন ব্যাংক স্থাপনের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে জলাশয়ের দেশীয় মাছগুলোর সুরক্ষা করা। প্রকৃতিতে যদি কোনো কারণে কোনো মাছ হারিয়ে যায় কিংবা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে এমন অবস্থায় চলে আসে, তাহলে লাইভ জিন ব্যাংক থেকে সেই মাছের প্রজনন এবং চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবনের মাধ্যমে আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। মূলত এ জন্যই লাইভ জিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়।

প্রবীণদের মতে, ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ নদীমাতৃক বাংলাদেশের চিরাচরিত প্রবাদ। নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, ডোবা-নালা ও জলাশয়ে প্রাকৃতিকভাবেই যুগ যুগ ধরে পাওয়া যায় নানা প্রজাতির মাছ। বৈশ্বিক জলবায়ুর প্রভাব, খরা, রাস্তা-ঘাট ও বাঁধ নির্মাণের কারণে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ফসলি জমিতে কীটনাশক ব্যবহারের কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছের উৎপাদন হ্রাস পায়। কয়েক দশক ধরে চলমান প্রাকৃতিক ও পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে দেশীয় প্রজাতির মাছ প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়। হারিয়ে যায় নানা প্রজাতির সুস্বাদু মাছ। মাঝেমধ্যে বিলুপ্তপ্রায় জাতের মাছ পাওয়া গেলেও উচ্চমূল্যের কারণে মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্তের মানুষের খাবার টেবিল দিনে দিনে মৎস্যশূন্য হয়ে পড়ে। ভোজনরসিকরাও হতাশ হন।

জানা যায়, ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠাকালে দেশে মাছের উৎপাদন ছিল মাত্র ১০ লাখ মেট্রিক টন। দেশে স্বাদুপানির ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৬৪ প্রজাতির মাছ বিপন্নপ্রায়। এরমধ্যে ২৪ প্রজাতির মাছ গবেষণার মাধ্যমে সংরক্ষণ, প্রজনন ও বংশ এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত ৩৫ বছরের ব্যবধানে মাছের উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে পাঁচ গুণের বেশি। দেশে মাছের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৪২ লাখ মেট্রিক টন। চলতি বছর মাছের উৎপাদন হয়েছে ৪৩ লাখ ৮৪ হাজার মেট্রিক টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে মাছের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৫ লাখ ৫২ হাজার মেট্রিক টন। দেশ এখন মাছ উৎপাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ বছর বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের পরিমাণ বেড়ে গেছে। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয় এবং খামারি পর্যায়ে চাষের মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বিশ্বের পঞ্চম স্থানে রয়েছে। তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ আর ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে। উন্মুক্ত জলাশয়, নদ-নদী, খাল-বিল, কাপ্তাই লেক, সুন্দরবন ও প্লাবনভূমির পরিমাণ প্রায় ৩৯ লাখ ২৭ হাজার হেক্টর। বদ্ধ জলাশয়, পুকুর, হাওর-বাঁওড়, চিংড়ি ঘের, কালচার ও খাঁচায় মাছ চাষের পরিমাণ প্রায় ৭ লাখ ৯৮ হাজার হেক্টর। সামুদ্রিক জলাশয়ের পরিমাণ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার এবং সমুদ্র উপকূল ৭১০ কিলোমিটার। এরমধ্যে উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ১৯৮৩-৮৪ সালে উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ আহরণ প্রায় সাড়ে ৬২ শতাংশ হলেও ২০১৭-১৮ সালে হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ২৮ শতাংশে। পক্ষান্তরে বদ্ধ জলাশয়ে মাছ আহরণের পরিমাণ সাড়ে তিন গুণ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় সোয়া ৫৬ শতাংশ। এটাই ছিল গবেষকদের বিরাট সাফল্য।

ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, ৪৭ লাখ হেক্টর অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের মধ্যে ৩৯ লাখ হেক্টর মিঠাপানির উন্মুক্ত জলাশয় এবং ৮ লাখ হেক্টর বদ্ধ জলাশয়। গবেষণার মাধ্যমে ৮ লাখ হেক্টর জলাশয় থেকে ৫৭ শতাংশ মাছ পাওয়া যায়। আর উন্মুক্ত জলাশয়ে পাওয়া যায় ২৭ শতাংশ। মাছ উৎপাদন বাড়াতে উন্মুক্ত জলাশয় এবং বিস্তৃত সমুদ্রকে বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় আনতে পারলে মাছের উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে জানান তিনি। বিএফআরআই মহাপরিচালক জানান, দীর্ঘ দিন ধরে ধারাবাহিক গবেষণায় ২৪ প্রজাতির মাছের পোনা উৎপাদন এবং চাষাবাদ পদ্ধতির প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সফল হয়েছেন গবেষকরা। এর মধ্যে পাবদা, গুলশা, গুজিআইড়, রাজপুঁটি, চিতল, মেনি, টেংরা, ফলি, বালাচাটা, শিং, মহাশোল, গুতুম, মাগুর, বেড়ালী, কুঁচিয়া, ভাগনা, খলিশা, কালিবাউশ, কই, বাটা, গজার, সরপুঁটি, গণি মাছ ও আঙ্গুস। ঢেলা, শালবাইন, কাকিলা ও ভোল মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়েও গবেষণা চলছে। এ ছাড়া উন্মুক্ত জলাশয় থেকে যে মাছগুলো বিলুপ্ত হতে চলেছে সেগুলো সংরক্ষণ করে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদনের পর জলাশয়ে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করার গবেষণা করা হচ্ছে। মাছ চাষে এখন উচ্চশিক্ষিতরাও জড়িয়ে পড়ছেন। মোটা অঙ্কের বিনিয়োগও হচ্ছে। তিনি আরো জানান, জাতীয় অর্থনৈতিক কমিটি (একনেক) অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বাড়াতে ২০২ কোটি ৪ লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন মৎস্য অধিদফতর ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। এতে অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মাছের উৎপাদন ৩ লাখ ৮৩ হাজার মেট্রিক টন হতে ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি করে ৪ লাখ ৪৬ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত করা সম্ভব হবে। মহাপরিচারক বলেন, লাইভ জিন ব্যাংক দেশের জন্য বিশাল একটি গৌরবের বিষয়। দেশীয় মাছ আমাদের কৃষ্টি এবং সংস্কৃতির একটি অংশ। আমরা চাই দেশীয় মাছ যেগুলো আছে সবগুলো আমাদের জলাশয়ে থাকুক। আমরা যেন সকল মাছগুলোকে পুনরায় আমাদের খাবার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে পারি সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি।’ তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে আমরা চাই যে মাছগুলো হারিয়ে গেছে বা হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে সবগুলোকে আমরা উদ্ধার করতে। সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে এখন গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করেছে। আগে শুধু ময়মনসিংহের গবেষণা কেন্দ্রে দেশীয় মাছগুলো রক্ষার জন্য গবেষণা করা হতো। এখন গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করেছি। নীলফামারি, সৈয়দপুর, যশোর ও বগুড়ার শান্তাহারে চারটি উপকেন্দ্র আছে। এসব উপকেন্দ্রে একইভাবে একই সময়ে গবেষণা করা হচ্ছে।

ড. ইয়াহিয়া আরো জানান, ইলিশ মাছ সারা বছরই কমবেশি ডিম দেয়। গবেষণা করে দু’টি সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম বের করা হয়েছে। একটি হলো জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি আরেকটি অক্টোবর-নভেম্বর। এ দুইটি মৌসুমের মধ্যে অক্টোবর-নভেম্বর হচ্ছে সবচেয়ে বড় মৌসুম। ওই সময় ইলিশ সবচেয়ে বেশি ডিম দেয়। এ জন্য প্রথমে ১০ দিন, পরে ১৫ দিন ২০১৬ সাল থেকে ২২ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ রাখা হচ্ছে। ফলে ‘জাটকা’ ইলিশ পরিবারে যুক্ত হয়ে দেশে প্রচুর ইলিশ আহরণ হচ্ছে এবং দামও সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেই রয়েছে।

এ দিকে মৎস্য অধিদফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রায় ৮৮ হাজার মেট্রিক টন মাছ আমদানি করা হলেও পরের বছর ১০ হাজার মেট্রিক টন আমদানি হ্রাস পায়। অর্থ্যাৎ, মাছের উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার কারণে মাছের আমদানি কমেছে। আমদানিকৃত মাছের বেশির ভাগই সামুদ্রিক মাছ। সূত্র মতে, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, বগুড়া, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ কয়েকটি জেলায় পুকুর এবং ঘেরে মাছ চাষে বিপ্লব ঘটেছে। দেশের নদ-নদীসহ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে ৫৩৪ টি মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন করা হয়েছে। এতে মাছের উৎপাদন ১৪০ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে। অভয়াশ্রমের কারণে দেশীয় মাছের উৎপাদন বেড়েছে বলেই মাছ সহজলভ্য হয়েছে।নয়া দিগন্ত

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়