ফরিদ কবির: আমাদের একটাই মেয়ে। যদি আগে থেকে যদি জানা যেতো, আরো ১১টা সন্তান নিলে প্রত্যেকটাই কন্যা সন্তান হবে, তবে আমি ১২টাই কন্যাসন্তান নিতাম। কিন্তু মানুষের সবচাইতে বড় সীমাবদ্ধতা এটাই যে সে তার নিজের পছন্দমতো সন্তান নিতে পারে না।
যদি মানুষের চাহিদামতো সন্তান নেয়ার সুযোগ থাকতো তাহলে ভারতীয় অনেক অঞ্চলের দম্পতিরা সব পুত্রসন্তান চাইতো!
আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষও তাই চায়।
কেন ছেলে সন্তান চায় মানুষ?
কারণ বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা, ছেলেসন্তানের মধ্য দিয়ে মানুষ তার বংশের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারে। বংশের পরম্পরার মাধ্যমেই মানুষ মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকতে চায়।
কিন্তু আসলে কি তা সম্ভব?
আমার বাবার মাধ্যমে কি আমার দাদা বেঁচে ছিলেন?
কিংবা আমার মাধ্যমে কি বেঁচে আছেন আমার বাবা?
আমার নিজের ধারণা, মানুষ নিজের কোনো কর্ম, নিজের কোনো সৃষ্টি, নিজের কোনো আদর্শ পৃথিবীতে না রেখে মরে গেলে তার অবস্থাটা অন্য পশু-প্রাণির মতোই ঘটে। কয়েকটা বাচ্চাকাচ্চার জন্ম দিয়ে মরে গেলে অন্য পশু-প্রাণির মতো মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেই মানুষও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় পৃথিবী থেকে।
সক্রেতিসের মতো পুত্রর জন্ম দিলেও সক্রেতিসের বাবা তার মাধ্যমে আসলে বেঁচে থাকেন না। সক্রেতিস বেঁচে আছেন এখনো সেটা তার নিজের কর্মের জন্য। যেমন বেঁচে আছেন রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ দাশ, যেমন বেঁচে আছেন বঙ্গবন্ধু।
তারা প্রত্যেকেই মৃত্যুর পরেও বেঁচে আছেন নিজেদের কর্মের জন্য। নিজেদের সৃষ্টির জন্য।
পৃথিবীজন্মের পর কোটি কোটি মানুষ পরপারে চলে গেছেন, এবং তাদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছেন দুনিয়া থেকে। মৃত্যুর পরেও বেঁচে আছেন আসলে খুব অল্পকিছু মানুষ। এই পৃথিবীকে যারা বাসযোগ্য করতে কোনো না কোনো অবদান রেখে গেছেন।
অথচ যারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছেন তাদের মধ্যে আছেন অনেক প্রতাপশালী, অনেক সম্পদশালী মানুষও। এর অর্থ, প্রভাব-প্রতিপত্তি বা সম্পদও মানুষকে মৃত্যুর পর বাঁচিয়ে রাখতে পারে না। মানুষ তখন নিজের সন্তানের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকার, নিজের বংশ টিকিয়ে রাখার স্বপ্ন দেখেন।
আমার সে রকম ইচ্ছে নেই। পুত্রের মাধ্যমে বংশ রক্ষা বা নিজের নাম বাঁচিয়ে রাখারও কোনো অভিপ্রায় আমার নেই। আমি জানি, নিজের পরিচয় আমি নিজে সৃষ্টি করতে না পারলে, নিজের পরিচয় নিজে রক্ষা করতে না পারলে আমার সন্তানও তা আমার জন্য করে দিতে পারবে না। কাজেই আমার জন্য ছেলে বা মেয়ে দুটোই সমান।
আর, ছেলে সন্তান হলেই বুড়ো বয়সে আমাকে আশ্রয় দেবে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। এ ক্ষেত্রে বরং মেয়েসন্তানরা বেশি বাবা-মার প্রতি নৈকট্য বোধ করে। বিপদেআপদে তারাই এগিয়ে আসে বেশি।
আমি এটুকু জানি, আমার নিজের পরিচয় আমার নিজেকেই তৈরি করতে হবে। না পারলে মৃত্যুর পর আমাকেও নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হবে। একইভাবে আমার মেয়েকেও নিজের পরিচয়েই পরিচিত হতে হবে। আমার পরিচয়ে নয়। আমি তাকে এ শিক্ষাই দিয়েছি, যাতে সে হাজার মানুষের মধ্যে নিজের পরিচয় তৈরি করে নিতে পারে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কোনো ভালো দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে না পারলে মানুষের জীবনও শেষ অব্দি কুকুর-ছাগলের জীবনের মতোই।
আমি ঠিক জানি না, কোনো এক অজানা কারণে কন্যাশিশুদের প্রতিই আমার পক্ষপাত বেশি। নারীদের যে কোনো অর্জনে আমি খুশি হই। আমার ধারণা, এ পৃথিবী তখনই সুন্দর হয়ে উঠবে যখন আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র হয়ে উঠবে মাতৃতান্ত্রিক। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :