মঞ্জুরুল হক: মাওলানা আহমদ শফী মারা গেছেন। স্বাভাবিক মৃত্যু। বাংলাদেশে ২০১৩ সালের পর থেকে সবচেয়ে আলোচিত এবং নিন্দিত ব্যক্তি। বাংলাদেশের বুর্জোয়া রাজনীতির নোংরামি নিয়ে বিস্তারিত বলতেও গা ঘিন ঘিন করা অনুভূতি হয়। তারপরও কিছু প্রশ্ন এবং তার উত্তর খোঁজা জরুরি। [১] ধর্মীয় নেতারা পৃথিবীর সব দেশেই নিজেদের সীমাহীন ক্ষমতাধর মনে করেন। শফী সাহেবও তাই করতেন। তিনি বরং ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার বাইরের শাসকশ্রেণির প্রকাশ্য সমর্থন পেয়েছিলেন। তাই নিজেকে দেশের শীর্ষ পদের লোক মনে করতেন। এটা প্রমাণিত-আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি এবং অনুসারী ইসলামী দলগুলো তাকে কাউন্টলেস পাওয়ার দিয়েছিলো।
[২] সেই ক্ষমতাবলে তিনি এর-ওর মৃত্যুদণ্ডও ঘোষণা করতেন। নারীদের বিরুদ্ধে শত শত ধর্মীয় নেতা কুৎসা রটিয়েছেন, ভৎর্সনা করেছেন তীব্রভাবে। নরকের কীট মনে বলেছেন। কিন্তু সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং অশ্লীল মন্তব্য করেছিলেন আহমদ শফী এবং সে কারণে দেশের শীর্ষ নেত্রী তাকে ‘মৃদু সমালোচনা’ করে আবার পাশে বসিয়ে ‘জাতির মুরুব্বি’ আখ্যাও দিয়েছিলেন।
[৩] তিনি ছিলেন দেশের নোংরা বুর্জোয়া-ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির দাবার গুটি। তাকে দিয়ে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল বিএনপি-জামায়াত। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চেয়েছিল জাতীয় পার্টি এবং তাকে দিয়েই আবার দুই প্রধান প্রতিপক্ষকে কূপোকাত করেছিলো আওয়ামী লীগ। শেষ বিচারে তাকে সবচেয়ে কার্যকরভাবে ‘ইউজ’ করেছিলো আওয়ামী লীগ।
[৪] তার দলের নেতারাই দেশে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলো। হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মঈনুদ্দিন রুহী ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্তরে শেখ হাসিনাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছেড়ে পালানোর আলটিমেটাম দিয়েছিলেন।
[৫] হেফাজতে ইসলাম একটি ‘অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন’ হওয়ার পরও দেশের শিক্ষাসূচি পরিবর্তন করিয়েছে, হিন্দু লেখকদের লেখা পাঠ্যবই থেকে অপসারণ করিয়েছে, নারীদের অন্তঃপুরে আটকে রাখায় অর্ধেক সফল হয়েছে, সারা দেশে প্রাচীন বাংলার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বাউল গান-পালা গান-জারি-সারি-কবি গান হতে দেয়নি। যাত্রপালা নিষিদ্ধ করিয়েছে। দেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি, সামাজিক বিন্যাস, নারী স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, পরমতসহিষ্ণুতা, ধর্ম নিরপেক্ষতা (!), মানুষের জীবনযাপন সবকিছুতেই তারা নাক গলিয়েছে এবং সিলসিলায় অনেকটাই সফল হয়েছে।
দৃশ্যত বাংলাদেশ এই মুহূর্তে ‘হেফাজতি ভাবধারায় পরিচালিত’ হচ্ছে। তাদের ১৩ দফার প্রায় ১০টি দফা সরকার মেনে নিয়ে প্রচলনও করেছে। সুতরাং আহমদ শফীর মৃত্যু মানেই হেফাজতি রাজনীতির শেষ নয়। শেষকালে ক্ষমতার কামড়া-কামড়িতে আহমদ শফী পরাজিত হয়ে বরং আরও বেশি ক্ষমতার কামড়া-কামড়ির সূচনা করে গেলেন। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এই রাজনীতির সাথে ধর্মের কোনো সংশ্রব নেই। পুরোটাই অর্থনৈতিক এজেন্ডা। ব্যাপারগুলো সেই আলোকে জানা-বোঝা দরকার। রাজনীতিটা শেষ নয়, নতুন ফ্রন্টে শুরু হলো। ফেসবুক থেকে