সুলতান মির্জা: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের ইতিহাসের আরেকটি কলঙ্কজনক ও রক্তাক্ত দিন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়। এর ঠিক ৩০ বছর পর সেই আগস্ট মাসেই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকার রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করে সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালায়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন সময়ে সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে উগ্রবাদী জঙ্গি বোমা-গ্রেনেড হামলা ও সন্ত্রাসের প্রতিবাদে তৎকালীন প্রধানবিরোধী দল আওয়ামী লীগ এক সমাবেশের আয়োজন করেছিল। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ট্রাকের ওপর স্থাপিত মঞ্চে দাঁড়িয়ে সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী আওয়ামীলীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্য শেষ করার পর পরই বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে অতর্কিত চারিদিক থেকে গ্রেনেড এসে পড়তে থাকে।
ওই সময় মঞ্চে উপবিষ্ট দলের জাতীয় নেতারা পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে মানববর্ম রচনা করে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে সেদিন শুধু গ্রেনেড হামলাই চালানো হয়নি, তিনি যখন গাড়িতে করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করছিলেন, তখনো বঙ্গবন্ধু কন্যাকে লক্ষ্য করে গাড়িতে গুলি চালানো হয়েছিলো। সেই দিনের সেই চিত্র ছিল ইতিহাসের নারকীয় গঠনা গুলোর মধ্যে একটি। অল্পের জন্য যদিও শেখ হাসিনা রক্ষা পেয়েছিলেন কিন্তু চারিদিকে মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়ে গিয়েছিল সেই দিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লাশের সারি, আহত মানুষের আত্মচিৎকার, একটু বেঁচে থাকার আকুতি। যা বলে লিখে বোঝানোর মতো অবস্থা নেই।
গ্রেনেড হামলার পরের ঢাকা শহরের হাসপাতালগুলোর চিত্র ছিলো আরো রহস্যজনক, সরকারি হাসপাতালে গ্রেনেড হামলায় আহত রোগীদের ভর্তি করা হয়নি, বেসরকারি হাস্পাতালগুলোতে রোগী ভর্তি হলেও যেন চিকিৎস্যা না পায়, সেজন্য করা হয়েছিলো কৃত্রিম বাধা বিপত্তি, ব্ল্যাড ব্যাংক রক্তশূন্য, ওষুধ সংকট, ডাকার সংকট, নার্স সংকট, অর্থাৎ একটি প্ল্যানিং কিলিং মিশন কমপ্লিট করতে খালেদা জিয়ার সরকার সকল ব্যবস্থা সম্পাদন করেছিল পুর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে। সেই বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় নিহত হয়েছিলেন প্রয়াত রাষ্টপতি জিল্লুর রহমান এর সহধর্মিনী আইভি রহমান, তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী মাহবুবুর রশীদ, আবুল কালাম আজাদ, রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারি, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, বেলাল হোসেন, মামুন মৃধা, রতন শিকদার, লিটন মুনশি, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা). মোশতাক আহমেদ সেন্টু, মোহাম্মদ হানিফ, আবুল কাশেম, জাহেদ আলী, মোমেন আলী, এম শামসুদ্দিন এবং ইসাহাক মিয়া সহ ২৪ জনের মৃত্যু হয়।
মারাত্মক আহত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, এডভোকেট সাহারা খাতুন, মোহাম্মদ হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, নজরুল ইসলাম বাবু, আওলাদ হোসেন, সাঈদ খোকন-সহ এই বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় ৪শ জন। আহতদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাদের কেউ কেউ আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি। এখনো স্পিটারের আঘাত নিয়ে ধুকে ধুকে জীবন কাটাচ্ছেন। সেদিন যারা আহত হয়েছিলেন তাদের অনেককেই সারা জীবন গ্রেনেডের স্পিন্টার বহন করে চলতে হবে। পরবর্তী সময়ে ঢাকার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ, আবদুর রাজ্জাক,সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, এডভোকেট সাহারা খাতুন শরীরে অসংখ্য গ্রেনেড এর স্প্রিন্টার নিয়ে জীবনের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
গ্রেনেড হামলার পরে আইনি বিষয়ে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকারের কর্মকাণ্ড ছিল আরও সন্দেহজনক, আওয়ামী লীগ নেতারা মামলা করতে থানায় থানায় ঘুরেছে, মামলা দিতে পারেনি, পুলিশের আচরন ছিলো রহস্যজনক। স্মরণকালের ভয়াবহ সেই গ্রেনেড হামলার বিষয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ ছিলো আরো হাস্যকর, গ্রেনেড হামলার ঘটনা ধামাচাপা দিতে ঐ সময়ের স্বরাষ্ট প্রতিমন্ত্রী বাবরের তত্ত্বাবধানে একটি লোক দেখানো তদন্ত হয়েছিলো, এতে জজ মিয়া নামে এক ভবঘুরে, একজন ছাত্র, একজন আওয়ামী লীগের কর্মীসহ ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকার একটি নাটকীয় তদন্তের মাধ্যমে শুধু জজ মিয়া নাটকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। গ্রেনেড হামলার সকল আলামত নষ্ট করে দিয়েছিল যাতে করে ভবিষ্যতে আর এই গ্রেনেড হামলার কোনো আলামত খুঁজে পাওয়া না যায়।
যদিও শেষ রক্ষা হয়নি, ২০০৬ সালে বিএনপি জামাত জোট সরকারের মেয়াদের পরে, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃতাধীন মহাজোট সরকার তদন্ত, অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে আইনি সকল ধাপ অতিক্রম করে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা করেন। এ মামলায় মোট ৫২ জন আসামির মধ্যে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। একই সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পলাতক তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন রায় দেওয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে মোট ১১ আসামিকে। বাকি তিন জনর অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় তাদের এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এদের মধ্যে লুৎফুজ্জামান বাবর এবং আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ৩৩ জন বর্তমানে কারাগারে আছেন। রায় ঘোষণার সময় তারেক রহমান এবং হারিছ চৌধুরীসহ ১৮ জনকে মামলার নথিতে পলাতক দেখানো হয়েছিল। রায় পরবর্তী সময়ে পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাইদ হাসান এবং ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার ওবায়দুর রহমান খান আদালতে আত্মসমর্পণ করায় এখন পলাতক রয়েছেন ১৬ জন। আজকে ২১ আগস্ট বর্বোরচিত সেই গ্রেনেড হামলায় নিহত সকলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রকাশ করছি। পাশাপাশি সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, অতি দ্রুত পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করার ব্যবস্থা করা হোক।
লেখক : রাজনৈতিক কর্মী