মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে ছিলো গভীর ষড়যন্ত্র। সেই ষড়যন্ত্রে সামরিক বাহিনীর ট্যাঙ্ক, কামান ও অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল, জড়িত উচ্চাভিলাষী ষড়যন্ত্রকারী কিছু কর্মকর্তা এবং চাকরিচ্যুত সামরিক কিছু কর্মকর্তা। তবে এদের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিলো বেসামরিক আমলা, কিছুসংখ্যক রাজনীতিবিদ এবং স্বার্থান্বেষী মহল। তাদেরকে সার্বিকভাবে মদদ যুগিয়েছিল আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী মহল। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে এরা হয়তো তেজগাঁও বিমানবন্দর দিয়ে পালিয়ে যাওয়ারও ব্যবস্থা ছিলো। গোপন এই ষড়যন্ত্রটি আঁটা হয়েছিল দীর্ঘদিন থেকে, সম্ভবত ১৯৭২ সালের পর থেকে।
প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল? তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী ছিল? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল পাকিস্তান নামক একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ব্যবস্থার আদর্শ ও কাঠামোকে ভেঙ্গে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নীতি ও পরিকল্পনা ছিলো আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার। এই লক্ষ্যে ১৯৭২ সালেই বঙ্গবন্ধু একটি চমৎকার সংবিধান জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন। একইসঙ্গে একটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে জাতিকে একটি শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থায় পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন। এছাড়া একটি নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়নের মাধ্যমে নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে দ্রæত বিকাশমান করার জন্য আধুনিক সুশিক্ষিত, দক্ষ, জাতিগঠনের পরিকল্পনা ছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী ঘোষণা করেছিলেন। এর মাধ্যমে ঔপনিবেসিক প্রশাসন ব্যবস্থা ভেঙ্গে জনগণের কল্যাণকামী প্রশাসন গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলেন, ভ‚মি সংস্কার, অর্থনৈতিক সংস্কার এবং জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করার রাজনৈতিক প্লাটফর্ম তৈরি করলেন। বঙ্গবন্ধুর এইসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কয়েকটি বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় তার অধিষ্ঠিত থাকা প্রয়োজন ছিলো। তিনি যে মাপের রাজনৈতিক নেতা এবং রাষ্ট্রচিন্তক ছিলেন তার পক্ষে শুধু স্বাধীনতা দেওয়াই যথেষ্ট ছিলো না, আধুনিক শোষণহীন জাতিরাষ্ট্র গঠন করাও অসম্ভব ব্যাপার ছিলনা।
কারণ মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশটাকে তিনি যেভাবে ঢেলে সাজাচ্ছিলেন তাতে এটি স্পষ্ট হচ্ছিল যে, তার পরিকল্পনা অনুযায়ী রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ অচিরেই একটি উন্নত, সমৃদ্ধ জাতিরাষ্ট্র হিসেবে গঠিত হতোই। কিন্তু আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী তেমন বাংলাদেশ দেখতে চায়নি। তাদের কাছে পছন্দের ছিলো পাকিস্তানী ভাবাদর্শ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অনুগত রাষ্ট্র ও সরকার। সে কারণেই তারা বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথে বাংলাদেশ যেন অগ্রসর হতে না পারে সে কারণে দেশের অভ্যন্তরে তাদের মদদপুষ্ট লোকদের ষড়যন্ত্রের রূপরেখা প্রণয়নে সাহায্য করেছিল- যেমনিভাবে অন্যদেশেও অভ্যূত্থান পরিচালনার জন্য করা হতো। দুঃখের বিষয়, বঙ্গবন্ধু তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের যে জাল বুনা হচ্ছিল সেটি সম্পর্কে ততোটা সচেতন ছিলেন না, কিংবা তিনি ষড়যন্ত্রকে গুরুত্বই দিতে চান না। তার বিশ্বাস ছিলো পাকিস্তানীরা যেখানে তার গাঁয়ে টোকা দেওয়ার সাহস পায়নি সেখানে বাংলাদেশের কেউ তাকে হত্যা করতে পারে কিংবা অভ্যুত্থান ঘটানোর মতো ষড়যন্ত্র করতে পারে এটি তার বিশ্বাসে ছিলনা। কিন্তু বর্তমান বিশ্বরাষ্ট্র রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক শক্তির ষড়যন্ত্র খুবই নির্মম, নিষ্ঠুর এবং রক্তাক্ত হতে দেখা যায়। এটি শ্রেণী ও রাষ্ট্র চরিত্রের সমস্ত গোষ্ঠীর স্বার্থগত বিষয়। সেখানে আবেগ, ভালোবাসা, দেশপ্রেম, মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধা, ইত্যাদি ষড়যন্ত্রকারীদের কাছে কানাকড়িও মূল্য নেই। সে কারণেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্ষমতা দখলের সময় রক্তপাতও যথেষ্ট পরিমাণে ঘটেছিল। বাংলাদেশে যারা ষড়যন্ত্রের জাল এটেছিলেন তারা বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব, জনভিত্তি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলো। সে কারণে ষড়যন্ত্রকারীরা ট্যাঙ্ক নামিয়ে ছিলো মানুষকে ভয় দেখিয়ে ঘরে আবদ্ধ রাখার জন্য। আবার বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রবেশ করে মুহূর্তের মধ্যেই সবাইকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। একইভাবে শেখ মনি এবং শেরেনিয়াবাতের পরিবারেও নৃশংস হত্যাকান্ড সংগঠিত করেছিলেন।
তাদের মধ্যে একদিকে জিজ্ঞাংসা অন্যদিকে ভিত্তিও কাজ করেছিল। সে কারণে তারা কাউকেই বাঁচিয়ে রাখেনি। তাদের পরিকল্পনা ক্রমেই প্রসারিত হয়েছে। ক্ষমতা দখলের পর বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ রাজনীতিবিদদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জেলখানায় চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। বেশিরভাগ নেতাদের জেলে আটকে রাখা হয়েছে। পরিকল্পনা মোতাবেক ১৫ আগস্টের দিন থেকেই পাকিস্তানী ভাবাদর্শে সরকার পরিচালনা, রাষ্ট্রব্যবস্থা ঢেলে সাজানো এবং বঙ্গবন্ধুর গৃহিত সকল পদক্ষেপ বাতিল করা হয়েছিল। বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়েই ক্ষমতা দখল করা হয়েছিল। যদিও প্রথমে দুর্বল চিত্তের খন্দকার মোস্তাককে রাষ্ট্রপতি পদে বসানো হয়েছিল। তথাপিও এটি ছিলো সবাইকে বোকা বানানোর ফন্দি। অভ্যুত্থানের ৯ দিনের মাথায় সামরিক বাহিনীর প্রধান পদে যিনি আবির্ভূত হলেন তিনি প্রস্তুতি নিলেন খন্দকার মোশতাকের দুর্বল সরকারকে তাড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে আসার। এর মধ্যে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটলেও তিনি সফল হলেন ক্ষমতার শীর্ষে অধিষ্ঠিত হতে। কারণ গোটা ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে যারা ছিলেন তাদের পছন্দের ব্যক্তি এবং নেতৃত্ব দেওয়ার অবস্থান তার মধ্যেই ছিলো বলে তাকে আগে থেকেই এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হয়েছিল। এর সঙ্গে অবশ্য অতিবিপ্লবী, ডানবামের অনেকেই তাৎক্ষনিকভাবে যুক্ত হয়েগেলেন। আসলে এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রব্যবস্থা ব্যাহাত হয়ে গেল, প্রতিবিল্পবীদের হাতে চলে গেল। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িকতার দাঁড়ায় প্রবেশ করল, বিসর্জিত হলো মুক্তিযুদ্ধের চার জাতীয় মৌলনীতি। বাংলাদেশ কার্যত পাকিস্তানী ভাবাদর্শের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে গেলো।
রাজনীতিতে প্রথম ধারা ক্ষতবিক্ষত, দ্বিতীয় ধারাটি বঙ্গবন্ধুর রক্তের উপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতি পরিচালিত করার নীতিতে অনড় রয়েছে। বিকৃত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং ভাবাদর্শকে যুগের পর যুগ পরিচালিত করা হচ্ছে। যেখানে ১৯৭৫ সালের এতো রক্তপাতে তাদের মন কাঁদে না। বরং উল্লাস প্রকাশ না করলেও ক্ষতবিক্ষত রাষ্ট্র ও রাজনীতিকেই সম্বল করে তারা এগুচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের রাষ্ট্রীয় ক্ষত কোনদিনই শোকাবে না, রক্তঝরার ধারাও কোনদিন বন্ধ হবে না। বাংলাদেশের জন্য এই এক দুর্ভাগ্যের ইতিহাস- যা প্রতিবছর ১৫ আগস্ট সমাগত হলে আমাদেরকে দেখতে হচ্ছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ