মাসুদ কামাল: রিজেন্ট হাসপাতালে র্যাব অভিযান চালিয়েছে। অভিযান চালিয়ে র্যাব জানতে পেরেছে, বিস্তর অনিয়ম আর প্রতারণার কথা। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরুতে বেসরকারি হাসপাতালগুলো যখন কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় অনীহা প্রকাশ করতে থাকে, তখন শোনা যেতে থাকে রিজেন্ট হাসপাতালটির নাম। এ হাসপাতালটি মোটেই দেশের প্রথম সারির কোন প্রতিষ্ঠান নয়।
অনেকেই এর নাম আগে শুনেছন কিনা সন্দেহ। সাংবাদিকতা পেশায় থাকার কারণে আমি অবশ্য বছর চারেক আগেই এই হাসপাতালটি সম্পর্কে জানি। তখন আমাদের এক রিপোর্টার এই হাসপাতালের প্রতারণা ও দুর্নীতি বিষয়ক একটা রিপোর্ট নিয়ে এসেছিল। সে রিপোর্ট যাতে প্রচার না হয়, তার জন্য অনেক তদবিরও হয়েছিল। অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে ফোন এসেছিল। তবে সে সবে কাজ হয়নি, রিপোর্টটি ঠিকই প্রচারিত হয়েছিল। তারপরও এমন একটা বাটপার প্রতিষ্ঠানকেই সরকার কেন করোনা চিকিৎসার জন্য নির্বাচন করলো- সেটা আমার কাছে কিছুটা বিস্ময়কর ঠেকেছিল। আমি জানি- এদেশে দুর্নীতি কোনো গোপন বিষয় নয়, কিন্তু তাই বলে করোনার এই বৈশ্বিক প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও, খোদ করোনা চিকিৎসা নিয়েও দুর্নীতি হবে? সরকার তা করতে দেবে? আমি আসলেই বিস্মিত হয়েছিলাম। এই যে করোনা রোগীর চিকিৎসায় রাজি হওয়া, এর পেছনে আসলে রিজেন্টের মানবিক কোনো সহানুভূতি বোধকরি কাজ করেনি। কাজ করেছে তাদের ব্যবসায়িক ধান্দা।
সরকারের কাছ থেকে বিপুল অর্থ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা ছিল বলেই তারা এ কাজে নেমেছে। সরকারের সঙ্গে তাদের চুক্তি ছিল, তারা বিনামূল্যে কোভিড রোগীদের চিকিৎসা করবে, বিনিময়ে সরকার তাদেরকে সেই চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করবে। কিন্তু বাস্তবে তারা এই চুক্তিটি মোটেই মেনে চলেনি। তারা রোগীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আদায় করেছে, আবার বিনামূল্যে চিকিৎসা করেছে দাবি করে সরকারের কাছেও এক কোটি ৯৬ লাখ টাকার বিল জমা দিয়েছে। মানে গাছেরটাও খেয়েছে, তলারটাও কুড়িয়েছে। এখানেই শেষ নয়, বিনামূল্যে করোনার পরীক্ষা করার কথা থাকলেও রোগীদের কাছ থেকে ৩ থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা করে আদায় করেছে। অথচ সরকারের সঙ্গে তাদের চুক্তি ছিল যে, ভর্তি রোগীদের তারা কোভিড পরীক্ষা করবে বিনামূল্যে। কিন্তু তারা আইইডিসিআর, আইটিএইচ ও নিপসম থেকে ৪ হাজার ২০০ রোগীর বিনামূল্যে নমুনা পরীক্ষা করিয়ে এনেছে।
পাশাপাশি নমুনা পরীক্ষা না করেই আরও তিন গুণ লোকের ভুয়া করোনা রিপোর্ট তৈরি করে দিয়েছে।
অভিযানে আরও জানা যায়, ২০১৪ সালের পর এই হাসপাতালটি তাদের রেজিস্ট্রেশন আর নবায়ন করেনি। কেন করেনি? রেজিস্ট্রেশন নবায়ন করতে গেলে হাসপাতালের সক্ষমতার একটি প্রমাণ দিতে হয়। তাহলে কি তাদের সেই সক্ষমতা ছিল না? নাকি হাসপাতালের কর্তাব্যক্তি নিজেকে এতোটাই ক্ষমতাবান মনে করতেন যে, রেজিস্ট্রেশনের প্রয়োজনীয়তাকে তিনি পাত্তাই দেননি? এই কর্তাব্যক্তি, হাসপাতালের চেয়ারম্যান, মো. সাহেদকে আমি চিনতাম। কেবল আমিই নয়, দেশের অনেক মানুষই তাকে চেনেন। তিনি একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। টেলিভিশনের টকশোতে ওনাকে প্রায়ই দেখা যায়। কয়েকটা টকশোতে ওনার সঙ্গে আমিও ছিলাম। টকশোগুলোতে উনি জাতিকে জ্ঞান দেন, বিরোধী দলের সমালোচনা করেন, সরকারের প্রশংসা করেন। তার সেসব বক্তব্য শুনলে ওনাকে সরকার দলীয় লোক বলেই মনে হয়। সরকারি দলের কি একটা পদে রয়েছেন বলেও তিনি বিভিন্ন জায়গায় বলে থাকেন। এখন সরকার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত একটা লোকের যে বৈশিষ্ট্য র্যাবের এই অভিযানের পর সর্বসম্মুখে উন্মোচিত হলো, সেটা আসলেই চিন্তার বিষয়। আওয়ামী লীগের দু’একজন লোকের সঙ্গে এই লোকটি সম্পর্কে আমার কথা হয়েছে। তারা কেউই একে তাদের দলের লোক হিসাবে মানতে রাজি হননি। রাজি হননি, কিন্তু তাকে কিন্তু মুখের উপর কিছু বলেনওনি।
জি কে শামীমের কথা মনে আছে? ওই যে, মাফিয়া ঠিকাদার, নানা ধান্দা করে টাকার কুমির বনে গিয়েছিল, পরে র্যাবের হাতে ধরা খেল, সেও কিন্তু নিজেকে যুবলীগের নেতা বলে পরিচয় দিতো। পরে দেখা গেলো, সে দলের কেউ নয়। তাহলে দাঁড়ালোটা কী? এই সমস্ত লোকেরা নিজেদের স্বার্থে দলকে ব্যবহার করে, দলের বদনাম করে। এদের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের সুনাম বৃদ্ধি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নিশ্চয়ই নেই। বরং এরা যেখানেই যাবে, নিজ চরিত্রের দুর্গন্ধই কেবল ছড়াবে। নিজের সম্মান রক্ষার স্বার্থেই সরকারের উচিত হবে এদের ব্যাপারে কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আর একটা কথা বলা দরকার। সাংবাদিক হুমায়ূন কবির খোকনের মৃত্যু কিন্তু এই রিজেন্ট হাসপাতালেই হয়েছে। খোকন যখন মারা গেলেন, তখনও কিন্তু এই হাসপাতালের বৈধ কোনো লাইসেন্স ছিলো না। চিকিৎসার সক্ষমতা আছে কিনা, সেটা নিশ্চিত নয় যে হাসপাতালের, সেখানে করোনা আক্রান্ত একজন সিরিয়াস রোগীর সুচিকিৎসা হয়েছে নাকি অপচিকিৎসা হয়েছে- সেটাই বা নিশ্চিত হওয়ার উপায় কী? ভয়েসবাংলা