দীপক চৌধুরী : স্বৈরাচারী সরকারকে তখন বিতাড়িত করার জন্য আমরা প্রায় প্রতিদিনই ক্যাম্পাসে মিছিল নিয়ে বের হতাম। জিয়া-এরশাদ আমলে কিছু স্লোগান আমাদের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। যেমন : ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’; ‘এরশাদ তুই কবে যাবি;’ .. . চামড়া, তুলে নেবো আমরা;’ ...জুতা মারো তালে তালে;’ অমুক ভাইয়ের কিছু হলে জ¦লবে আগুন ঘরে ঘরে.. একজন স্লোগান ধরতেন, আমরা পরে তার কণ্ঠের সুরে সমস্বরে শক্তি দিয়ে উচ্চারণ করতাম। কে কত বেশি শক্তি দিয়ে গর্জে উঠতে পারে, স্লোগান ধরতে পারে এমন একটা মানসিক প্রতিযোগিতা ছিল। পুলিশের সঙ্গে আমাদের মুখোমুখি হওয়া নিয়মিত ব্যাপার। তাদের দেখলেই গা-জ¦ালা ধরে যেতো। আমাদের সহপাঠী ছিল ইংরেজী অনার্সের ছাত্র। সে-ই ছিল আমাদের মধ্যে পওসাওয়ালা। পকেটে দুনিয়ার টাকা থাকত। ‘খরচাপাতির’ হাত দেখেই বোঝা যেত। তবে বন্ধু হিসেবে ছিল অসাধারণ। তার বাবা পুলিশের একজন এসপি ছিলেন। অথচ সেও মিছিলে পুলিশকে ‘ঠোলা’ বলে গালি দিতো। মিছিলে আমাদের সঙ্গে ছিল সবসময়। পুলিশকে লক্ষ্য করে ‘ইঁটপাটকেল’ নিক্ষেপে সে সর্বাগ্রে থাকতো সর্বদা। ব্যক্তি পুলিশ কোনোও ইস্যু ছিল না, ব্যক্তি পুলিশের সঙ্গে বিরোধও নেই। ছিল আদর্শের সংগ্রাম, আদর্শের লড়াই। এমনকি সম্পর্কের কারণে একাধিক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে আমাদের ভাব হতো। চুরাশির দিকে একজন ট্রাফিক ইন্সপেক্টর বড়ভাইয়ের মতো ক্যাম্পাসপ্রাঙ্গন বা নীলক্ষেত এলাকায় ডিম সিদ্ধ, ডালপুরি, চা-চানাচুর খাওয়াতেন প্রায়ই। অর্থাৎ বিকেলের নাস্তা। দোকানির পয়সা পরিশোধ করতেন তিনিই। আমাদের মানে ছাত্রদের মানিব্যাগ অভিভাবকদের বা পিতার পাঠানো টাকার ওপর নির্ভর করতো। তাকিয়ে থাকতে হতো বাবার দিকে, ‘মনি-অর্ডার’ কবে আসবে। আমাদের ইস্যু ছিল স্বৈরাচারী সরকার। তারা সরকারকে রক্ষা করতেই যেন আমাদের মারছে, লাঠিপেটা করছে, গুলি করছে, আমাদের মিছিলের ওপর ট্রাক তুলে দিচ্ছে। কথায় কথায় একদিন ট্রাফিক ইন্সপেক্টর গল্পচ্ছলে বললেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকেই একদিন আমাদের স্যার হবে, তোমরাই পুলিশ হবে।’ কীভাবে স্যার হবোÑ এর উত্তর তিনিই দিলেন, বিসিএস দিয়ে পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার হবে, এএসপি, ডিরেক্ট অফিসার! স্বৈরাচরী এরশাদ আমলে ভয়ঙ্কর দিনগুলো আমরা অতিক্রম করে এসেছি। মৃত্যুগহ্বর থেকে আসা। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, স্লোগান দেওয়া মিছিলে যাওয়া কিংবা এর বিনিময়ে কিছু পাওয়া তো ছিল কল্পনাতীত। বড়জোর বা কালে-ভদ্রে মধুরকেন্টিনে চা-সিঙ্গারা। প্রথম যখন স্লোগান দিই সেটা জিয়ার আমল। আমি সুনামগঞ্জ কলেজের ‘ফার্স্ট ইয়ারের’ ছাত্র তখন। একদিন একজন ম্যাজিস্ট্রেট কলেজে এসেছিলেন। ‘রাজনীতি’ নিয়েই প্রশাসনিক নির্দেশ হয়তবা। দ্রুত খবর ছড়িয়ে পড়ল, তিনি নাকি আমাদের কলেজের স্যারের সঙ্গে চরম বেয়াদবি করে ফেলেছেন। এমনকী আমাদের প্রিন্সিপালের সঙ্গেও। এত বড় দুঃসাহস! এটা কী মেনে নেওয়া সম্ভব? এরপর আমরা কলেজ ক্যাম্পাসে মিছিল নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। প্রতিবাদ করাকালে ‘গুণ্ডা সালাউদ্দিনের চামড়া তুলে ফেলব আমরা’ স্লোগান তুললাম।
একটি বিষয় লক্ষ্য করেছি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের সঙ্গবদ্ধ লড়াইয়ের সময় সকল পত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছে। বলা হতো, ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ ‘মৃদু লাঠিচার্জ’ করেছে। তাদের লাঠির বাড়িতে কোমড় ভেঙ্গে গেছে তারপরও মৃদু? ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে স্লোগান দেওয়ার সময় আমাদের কত বন্ধু-সহযোদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, গুম করা হয়েছে যে, এই পরিসংখ্যান এ মুহূর্তে হাতে নেই। মিছিলে পুলিশের ‘লাঠির বাড়ি’তে কত বন্ধু-বান্ধব পঙ্গু হয়েছে, জীবনের জন্য অন্ধ হয়েছে তবুও পত্রিকায় লেখা হতো ‘মৃদু লাঠিচার্জ’ করে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা পরিস্থিতি শান্ত করে। আর এখন প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত ‘সীমিত আকার’ শুনছি আমরা টেলিভিশনে। সীমিত আকারে গণপরিবহণ চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে। অবশ্য, গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিয়ে দ্বিধা সাধারণ মানুষেরই। গণপরিবহনে সীমিত আকারে বসা এও কী সম্ভব? সীটে বসবো কীভাবে? আমরা তো কোলে বসতে অভ্যস্ত। হিতে বিপরীতও হতে পারে অনেকের আশঙ্কা। দেশের অর্থনীতি রক্ষা করার জন্য ‘সীমিত আকারে’ সবকিছুই করব। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য বারবার সরকার ও গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হচ্ছে। কিন্তু কোনোভাবেই সেটা মনে চলার তাগিদ চোখে পড়ে না। যারা পেটের তাগিদে কাজ করতে মাঠে নেমেছেন বাধ্য হয়ে তাদের কথা দূরে রাখলেও বাস্তবতা কী বলে? আসলেই যাত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করা কী সম্ভব? সামাজিক দূরত্ব মানা দূরের কথা, মুখে মাস্কও নেই। এটা বাজার হোক, দোকান-পাট হোক, চলাচলের রাস্তা হোক। অবশ্যই, সচেনতা তৈরি হোক। বিশে^র মানুষ এটিই এখন চাইছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন, ভিডিওকনফারেন্সে নিয়মিত প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন, প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন। করোনাযোদ্ধা চিকিৎসক সাংবাদিকেরা তো আছেনই। একইভাবে সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী, বিজিবি, আনসার সদস্যরা জীবনবাজি রেখে মাঠে কাজ করেছেন এবং মাঠে আছেন। বহু পুলিশ সদস্য প্রাণ দিয়েছেন। সচেতনতা তৈরি হোক আমরা চাই কিন্তু যেভাবে সামাজিক বিভিন্নদৃশ্য পর্যবেক্ষণ করছি তাতে তো মনে হচ্ছে, একশ্রেণির মানুষ, করোনাকালকে ‘মৃদু লাঠিচার্জের’ কাতারে নিতে চাইছে।
আমরা সবাই জানি, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর ধনি দেশ আমেরিকায়ও এক লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। করোনা লাতিন আমেরিকায় কোটি কোটি মানুষের অন্ন কেড়ে নিয়েছে। আর্থিক বুনিয়াদ অনেক দেশের থাকলেও বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশের হাতে কোভিডের ধাক্কা সামাল দেয়ার মতো টাকা নেই। এতে করে গোটা বিশ্বের অর্থনীতিই ঝুঁকির মুখে পড়েছে। আর এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হলে জরুরি অর্থায়ন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে, এটা সত্য। কিন্তু আমরা যেন ভীষণরকম উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছি। আমরা যেন ধৈর্য হারাচ্ছি। বিপদে তো ধৈর্য ধরতে হয়। ধীরস্থির সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এখন তো আমরা শুধু দৌড়াই। দৌড়াচ্ছি, হাঁটতে কী ভুলে গেছি?
লেখক : উপসম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি ও কথাসাহিত্যিক