শিরোনাম

প্রকাশিত : ২২ এপ্রিল, ২০২০, ১২:৫০ দুপুর
আপডেট : ২২ এপ্রিল, ২০২০, ১২:৫০ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

গ্রাহক সুরক্ষায় পরিকল্পনাহীন ব্যাংক

বণিকবার্তা : নভেল করোনাভাইরাসে লণ্ডভণ্ড অর্থনীতি মেরামতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি এগিয়ে আসছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও। প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই নিজ গ্রাহকদের টেনে তোলার পরিকল্পনা ঘোষণা করছে অনেক ব্যাংক। যদিও অনেকটা হাত গুটিয়ে বসে রয়েছেন বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণেই সময় কাটাচ্ছেন তারা।

নিজ গ্রাহকদের সুরক্ষা দিতে ৮৩০ কোটি ডলার রিজার্ভ গঠনের ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন জায়ান্ট জেপি মরগান চেজ। ৩৩০ কোটি ডলারের রিজার্ভ গঠনের ঘোষণা দিয়েছে ওয়েলস ফার্গো। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় এ দুটি ব্যাংকই নভেল করোনাভাইরাসে বিধ্বস্ত গ্রাহকদের টেনে তোলার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। স্থবির অর্থনীতিতে খেলাপি ঋণের অভিঘাত সামলানোর প্রস্তুতিও নিচ্ছে ব্যাংক দুটি। একই ধরনের প্রস্তুতির কথা জানাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকগুলোও। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি একেবারেই উল্টো। নগদ অর্থ জমা-উত্তোলনের মতো সেবা দিতেই নাকাল পরিস্থিতিতে পড়েছে দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক। সরকারি কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ আর জনগণের কাছে সরকারি সেবা পৌঁছে দিতেই লেজেগোবরে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। বিদ্যমান অচলাবস্থা ও করোনাপরবর্তী পরিস্থিতিতে ঋণগ্রহীতাদের টেনে তোলার চিন্তাও দেখা যাচ্ছে না ব্যাংকারদের মধ্যে।

এখন পর্যন্ত ঋণগ্রহীতা গ্রাহকদের বিষয়ে কোনো ঘোষণা আসেনি দেশের কোনো ব্যাংক থেকে। পরিস্থিতি নিয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে দেশের কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভা হয়েছে—এমন তথ্যও শোনা যায়নি। দেশের অন্তত এক ডজন ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে কথা বলেও এ বিষয়ে কোনো নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার কথাও জানা যায়নি। বেশির ভাগ ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীই বলেছেন, এখন ঝড় চলছে। আগে ঝড় থামুক। পরে দেখা যাবে, কী করা যায়।

বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ কিংবা শীর্ষ নির্বাহীদের মনোভাবের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের উদ্যোক্তা শ্রেণীর সামাজিক দর্শনের মধ্যে মানবসেবা করার মনোবৃত্তি খুবই কম। ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে বড় করপোরেট ও ধনী শ্রেণী যেভাবে নভেল করোনাভাইরাস মোকাবেলায় এগিয়ে এসেছে, সেভাবে আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে না। ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তারা চাইবেন বছর শেষে বড় মুনাফা। এক্ষেত্রে সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি অনেকাংশেই লোক দেখানো। ব্যাংকারদের যে কোনো কিছু ভাবতে হলে অবশ্যই উদ্যোক্তাদের মনোভাব বুঝে এগোতে হয়। তিনি বলেন, নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগে থেকেই বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বিপর্যস্ত ছিল। এখন গ্রাহকদের ব্যবসা যেমন বন্ধ, ব্যাংকের ব্যবসাও বন্ধ। ফলে আগামীতে সঠিক পথে হাঁটতে না পারলে দেশের অনেক ব্যাংকেরই অস্তিত্ব হারানোর আশঙ্কা আছে। বিশ্বের শতাধিক দেশের মতোই পুরোপুরি স্থবির হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে গত ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি চলছে। কয়েক দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে আপাতত ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। জরুরি সেবা ছাড়া বন্ধ রয়েছে সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। বিদ্যমান অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।

গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলো থেকে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা ছিল শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণ। এসএমই খাতে বিতরণকৃত ঋণ ছিল ২ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। চলমান লকডাউন পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং খাত থেকে বিতরণকৃত এ ঋণের প্রায় পুরোটাই ঝুঁকিতে পড়েছে। গ্রাহকদের খেলাপি হওয়া থেকে বাঁচাতে এরই মধ্যে ঋণ আদায় নীতিতে ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নেয়া ঋণ গ্রাহকরা ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত পরিশোধ না করলেও খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবেন না—এমন নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জারীকৃত নির্দেশনার ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় নেমে এসেছে শূন্যের কোটায়। উল্টো আমানতের অর্থ তুলে নেয়ার জন্য প্রতিনিয়ত ব্যাংকগুলোতে গ্রাহকদের ভিড় বাড়ছে।

ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের টেনে তোলার পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাহেল আহমেদ বলেন, নভেল করোনাভাইরাসের তাণ্ডব কতদিন থাকবে, সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নই। আগে ঝড় থামুক। তারপর পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানান অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমানও। তিনি বলেন, দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি যখন ৮ শতাংশের বেশি ছিল, তখনো ব্যাংকিং খাত সুস্থ ছিল না। বিশ্বব্যাংক বলছে, চলতি অর্থবছর বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২-৩ শতাংশে নেমে আসবে। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, দেশের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা কোন দিকে যাবে।

দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রথম সারিতে রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের প্রায় অর্ধেকই এসএমই খাতের। নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে সৃষ্ট চলমান অচলাবস্থায় এসএমই খাতই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পুঁজি কম হওয়ায় এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘুরে দাঁড়ানোও সবচেয়ে কঠিন। এ অবস্থায় গ্রাহকদের ভাগ্যের সঙ্গে ব্যাংকটির ভবিষ্যৎ জুড়ে গিয়েছে বলে মনে করেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ব্র্যাক ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহীতাদের টিকে থাকার সঙ্গে ব্যাংকের টিকে থাকাও নির্ভরশীল। গ্রাহকদের ভাগ্যকে পৃথকভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। দেশের অন্য সব ব্যাংকের পরিস্থিতিও তাই। নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে এসএমই খাতের উদ্যোক্তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ খাতের অনেক উদ্যোক্তাই হারিয়ে যাবেন। ব্যাংকের পক্ষ থেকে উদ্যোক্তাদের বাঁচাতে যথাসম্ভব চেষ্টা করা হবে।

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রাথমিকভাবে ঋণগ্রহীতাদের ৩ থেকে ৬ মাস সময় দিতে হবে। এর মধ্যে ঋণ পুনঃতফসিলের উদ্যোগও নিতে হবে। প্রয়োজনবোধে গ্রাহকদের চলতি মূলধন জোগান দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করা হবে। সমস্যা হলো, ব্যাংকে টাকা ফেরত আসার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ৩০ জুন পর্যন্ত গ্রাহকরা ঋণের কিস্তি দেবেন না। প্রতিনিয়ত ব্যাংক থেকে মানুষ আমানতের টাকা তুলে নিচ্ছেন। এ পরিস্থিতি আরো দীর্ঘায়িত হলে দেশের কোনো ব্যাংকের হাতেই বিনিয়োগ করার মতো টাকা থাকবে না। তখন চাইলেও গ্রাহকদের ঋণ দেয়া সম্ভব হবে না। পুরো পরিস্থিতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জোগান দেয়া তারল্যের ওপর নির্ভর করছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়