শেখ রেহানা : বাবার স্মৃতি কী বলে শেষ করা যায়। বাবা সবাইকে ভালোবাসতেন। আমি ছিলাম তার খুব কাছের। প্রতি জন্মদিনে তাকে প্রথম ফুলটা আমিই দিতাম। তিনি নিয়মিতো মর্নিংওয়াক করতেন। আমি তার সঙ্গে অতো জোরে জোরে হেঁটে পারতাম না। কিন্তু গেটে দাঁড়িয়ে থাকতাম। বাড়ির কাছাকাছি এলে আমি দৌড়ে কাছে চলে যেতাম। আমাদের বাসায় বেলী ফুলের গাছ ছিলো। আমি মালা গেঁথে আব্বাকে দিতাম। কখনো কখনো বাবার উপর বিভিন্ন করণে রাগও করেছি। হয়তো কোথাও যেতে চেয়েছি, তিনি যেতে দেননি। ফলে রাগ করে খাওয়া-দাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছি। বাবা নিজে আদর করে না-সাধা পর্যন্ত খাইনি। আব্বার রাত করে ফেরাটা কিছুতেই মেনে নিতে পারতাম না। রেগে গেলে বলতাম, পলিটিক্স করো কেন? বাবা বলতেন, তুই এমন কথা বলিস কেন? আমার কাছে তুইও যা, সাড়ে সাত কোটি মানুষও তা। এতে আমার রাগ আরও বেড়ে যেতো। বলতাম, আমি কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে পারবো না। আমি বুঝি, বাবা আমার কাছ থেকে ওই ধরনের বক্তব্য আশা করেনি।
আমার এখনো বিশ্বাস হয় না আব্বা নেই। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। প্রথমে আমাকে বিদেশ যেতে দিতে চাননি। বলছেন, তুই গিয়ে থাকতে পারবি না, কষ্ট হবে। তখন কেন যে আব্বার কথা শুনলাম না। কপালে দুঃখ ছিলো। তা না হলে একসঙ্গেই যেতে পারতাম। আমরা দু’বোন বেঁচে থাকার যন্ত্রণা কী অসহনীয়।
বাবা জেলে থাকতে প্রতি সপ্তাহে আমি চিঠি লিখতাম। সংসার, রাজনীতি সব কিছুর খবরই আমি তাকে দিতাম। সে সময়ের পত্রিকার রাজনৈতিক খবরের কাটিং রাখতাম। কোনো সপ্তাহে চিঠি লিখতে না পারলে আব্বার চিঠির প্রথম লাইনটি থাকতো, ‘মা তুই কি অসুস্থ, চিঠি লিখলি না?’ তার ইচ্ছা ছিলো আমি অনেক পড়াশোনা করি। কিন্তু তা তো হলো না। মনে আছে ’৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১২টার দিকে তিনি আমাদের বাসা থেকে চলে যেতে বলেন। আমরা যেতে চাইনি। আমি চিৎকার করে কান্নাকাটি করেছি। বাবা বলেছেন, পাকিস্তানি জেলে বসেও তার কানে আমার কান্না বেজেছে।
আব্বা মানুষকে খুব বিশ্বাস করতেন। পিতা হিসেবে খুবই ¯েœহশীল ছিলেন। তিনি চাইতেন, আমরা সারক্ষণ তার পাশে পাশে থাকি। ঝড়-তুফান হলে সারারাত তিনি ঘুমাতেন না। তসবি নিয়ে সারারাত তিনি ছোটাছুটি করতেন। আর বলতেন, ‘আল্লাহ আমার দেশ গরিব, তুমি রহমত করো’। আমরা তাকে একটু ঘুমাতে বললে বলতেন, ‘তোরা বুঝিস না, আজ কেউ বাঁচবে না’। সবার জন্য তার অফুরন্ত ভালোবাসা ছিলো। আব্বা বাইরে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, কিন্তু ঘরে এসে আমাদের সঙ্গে খেলার সময়ে শিশুরমতো হয়ে যেতেন। মাঝে মধ্যে ছাদে বসে আব্বার পাকা চুল বেছে দিতাম। শেষের দিকে পাকা চুল বাছার সময়ে একটা কাটা দাগ দেখিয়ে বললেন, আমার লাশ তো তোরা পাবি না, পেলেও চিনতে পারবি না। এই কাটাদাগ দেখে যদি চিনতে পারিস। তাই ওই কথা শুনে বুকের ভেতর ধক করে উঠেছিলো। ওই ধরনের কথা শুনতে আমার মোটেই ভালো লাগেনি। তাই এ নিয়ে আব্বাকে কোনোদিন কোনো প্রশ্ন করিনি। কেবল বলতাম এসব কথা বলবেন না। কিন্তু তার কথাই এভাবে সত্যি হয়ে গেলো। আব্বা চাননি আমি বিদেশে যাই। তিনি বলেছিলেন, বাইরে তোর ভালো লাগবে না, কান্নাকাটি করবি, গিয়ে কাজ নেই। তার কথা শুনিনি। কিন্তু বিদেশ গিয়ে দেখলাম, আব্বার কথাই হুবহু সত্যি। একটুও ভালো লাগছে না। কিন্তু লজ্জায় তাকে বলার উপায় নেই। তবু কয়েকদিন পর ১৩ আগস্ট টেলিফোনে আব্বাকে বললাম, আমি দেশে আসতে চাই, আমার একদম ভালো লাগছে না। আমার কথা শুনেই তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, কিরে আগে বলিনি, ঠিক আছে আমি টিকিট পাঠাবার ব্যবস্থা করছি, মন খারাপ করিস না’। এই তার সঙ্গে শেষ কথা। সূত্র : ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ গ্রন্থ থেকে