ইসরাত জাহান উর্মি: আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ নিয়ে আবহমান কাল ধরে চলে আসা ইয়ার্কি, ফাইজলামী শুরু হয়ে যাবে। ‘পুরুষদিবস নাই কেন’ লেখা হবে। পুরুষ নির্যাতন নিয়ে কথাবার্তা হয় না কেন প্রশ্ন তোলা হবে। তবে সারা বছর গালি খাওয়া, ঘৃণার শিকার হওয়া নারীবাদীরা আজ কিছুটা ছাড় পাবেন। ‘নারী হলো মায়ের জাত” বলা ঘরে নির্ভরতার স্ত্রী টি না থাকলে পুরুষেরা কি কি সমস্যায় পড়তে পারতো তার আবেগপ্রবন কিছু কিছু বর্ণনা আসবে পুরুষদের দিক থেকে। ওদিকে পার্পল বা ল্যাভেন্ডার কালারে ছেয়ে যাওয়া কিছু লীন ইন মার্কা কর্পোরেট নারীবাদ আমরা দেখতে পাবো। অনেক আগে গোধুলী আপার তোলা একটা ছবির কথা আমার মনে পড়বে। পেছনে লাক্স এর নারী দিবস পালনের বিরাট বিলবোর্ড এর সামনে গোলাপের বালতি মাথায় ফুল বিক্রতা নারীর গর্বিত দাঁড়িয়ে থাকা। ছবিটা বার্তা দিচ্ছিলো, সংগ্রাম নেবেন না সৌন্দর্য? বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান হবে। সারাবছর মেয়েদের ঊনচোখে দেখা কিছু মিডিয়া হাউজ ‘আজ হাউজ চলবে নারীর নেতৃত্বে’ মার্কা ফাইজলামী করবে। তবুও তো উদযাপন!
বুধবার একটা বুক ক্লাবের আমন্ত্রণে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে লেখক হয়ে ওঠার গল্প বলতে বলতে পাঠকের প্রশ্নের উত্তর দেয়া। একজন অল্পবয়সী তরুণ, নাম জুয়েল-খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন-পুরুষ নির্যাতন কি পরিমাণ হয় আপনার ধারনা আছে? বেকার আমাকে কি একটা চাকরীজীবী মেয়ে বিয়ে করে দায়িত্ব নেবে? আমাকে কিন্তু ঠিকই বউ পালতে হবে। জানেন আমার এক বন্ধু রাতে ঘরে থাকতে পারে না বউ এর নির্যাতনে? বউ ঘ্যানঘ্যান করে, সহ্য হয় না ওর। আরেকজন বললেন, পুরুষেরাও বউ এর হাতে মার খায়, একটা বউ মার খেলে যেমন সহজে বলতে পারে, একটা পুরুষ কিন্তু মার খেলে তা বলতে পারে না’
অনেকগুলো পয়েন্ট। আমি জানিনা অন্যরা কী বলবেন, আমি কিন্তু সত্যিই মনে করি, এবার কাজ করা দরকার পুরুষের উপরে। নারীর উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন অনেক হয়েছে, এইবার নজর দেয়া উচিত পুরুষের বেদনার দিকে। এটা খুবই অপমানজনক যে একজন পুরুষকে সফল হবার মাপকাঠি হিসেবে সবসময় প্রমাণ করতে হয় যে সে অর্থনৈতিকভাবে সফল। তাকে ব্রেড আর্নার হতেই হয়। নো অল্টারনেটিভ। এই ভার যতোদিন না নামছে পুরুষের কাঁধ থেকে পারিবারিক নির্যাতন কমবে না বোধহয়। যে আপনাকে খাওয়াবে পরাবে সে নির্যাতনও করবে এই সেদিনও এক জরিপে এই ভয়ংকর ভাবনা উঠে আসছে।
কাজ করা দরকার শাড়ি বা মেয়েদের পোশাক পরা শরীরে নারী কিন্তু মননে ব্যাটাগুলো নিয়েও। রুবানা হক টাইপ যাদের নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক হিসেবে আমাদের সমাজ দেখাতে চায় তারা জানায়, নারী দিবস দরকার নাই. দরকার মানুষ দিবস। কোনো লড়াই না করে ক্ষমতার মোয়া খাওয়া নারীরা ক্ষমতার চর্চা যারা পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম করেন না। আমার প্রতিদিনের যুদ্ধ, আমার প্রতিদিনের বেদনা আমাকে একটা নারী দিবসের সামনে আর দাঁড়াতে দেয় না। গণপরিবহনে ৯৪ ভাগ নারী হয়রানি হন, পরিবারে ৮৪ ভাগ নারী নির্যাতনের শিকার হন, ধর্ষণের হিসাব ভীতিকর, ধর্ষণের মামলার বিচার হয় না ৯৩ ভাগ, নারী বান্ধব প্রশাসন নেই- সেদিনও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন মার্জিয়া প্রভা, কর্মক্ষেত্রে হয়রানির শিকার অসংখ্য নারী, স্কুলে যাওয়ার পথে নিজেকে হিজাবে বোরখায় মুড়িয়েও রক্ষা পাচ্ছেন না ৯০ ভাগ ছাত্রী, যৌন হয়রানীর শিকার হচ্ছেন, ওয়াজ মাহফিল আর জুম্মা নামাজের খুতবায় প্রায় শতভাগ জুড়ে নারী অবমাননা, এগুলো কোনোটাই বায়বীয় হিসাব নয়, সব পরিসংখ্যান, রিসার্চ। আমার কাছে প্রতিদিন নারী দিবসের কথাগুলো বলার মতো জরুরি।
এখন নারী-পুরুষকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলো কোন্ মতবাদ? নারীবাদ? নারীবাদে কী বলা আছে, বেকার পার্টনারকে নারীর খাওয়াতে হবে? নাকি বলা আছে, দুজনকেই সক্ষম হতে হবে? কিছু নারী আরও আরও নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এই যে কপালে লিখে নিচ্ছেন বেশ্যা শব্দটি, তাতে কি থেমে যাবে তাদের কাজ করা? না কি যে পথ গেছে আড়ের পানে সে পথে তারা যাবেনই?
ভয়ংকর এক নারী বিদ্বেষী সমাজে বাস করে আমরা যেভাবে সিমপ্যাথাইজড হই পুরুষের প্রতি, পুরুষের দায়িত্বের বোঝার প্রতি, পুরুষ কি এ্যামপ্যাথেটিক সেরকমই? না কি নারীকে ঊন চোখে দেখে দয়া করে মাত্র? ধর্ম কেন চিরকাল পুরুষের পক্ষে থাকে? রাষ্ট্র কেন কেবলই সংবিধানে সকল নারীই সমান বলে খালাস পায়? কেন আইন আর বিচার নারীর পক্ষে থাকে না? বাপের সম্পত্তি মেয়ে সন্তান কেন পায় না নিয়ম অনুযায়ী? সন্তানের কাস্টডি কেন হয় বাবার? এইসব অতি পুরোন, ক্লিশে অথচ অমিমাংসিত প্রশ্নের জবাব এখন রাষ্ট্র, সমাজ, সমাজপতি, আইনপ্রণেতাদের কলজের ভেতর থেকে টেনে বের করার সময় আসছে। লং ওয়ে টু গো। এখনই যেন ক্লান্ত হোসনে আমার মন! বিশেষত পাশে থাকা পুরুষদের। যারা ভাগ করে নিয়েছিলেন বেদনা।