হিমেল রোজারিও : নারীর ক্ষমতায়নই হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের অন্যতম চাবিকাঠি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাঙালি নারীদের ক্ষমতায়নের পথিকৃৎ। তেমনি উঠে আসা ক্ষুদ্র এই খ্রিস্টান সম্প্রদায় থেকে এক নারী প্রচার বিমুখ যিনি শুধু উন্নয়নের কথা ভাবেন, উন্নয়নের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন বিশেষ করে নারীদের উন্নয়নের স্বপ্ন দেখেন। নেই কোনো অহংকার-দাম্ভিকতা যার নাম অ্যাডভোকেট সাবিনা শিপ্রা দাস। শুধু স্বামীর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা এবং নিজের অদম্য ইচ্ছার কারণেই শিপ্রা দাস আজ ‘হাইকোর্টের লিগাল এইড প্যানেলের ল’য়ার। স্কুলের গ-ী না পেরুতেই মনের মানুষের সঙ্গেই পারিবারিকভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কম শিক্ষিত থাকার কারণে শ^শুরবাড়ির অনেক আপত্তি ছিলো, কিন্তু নিজ চেষ্টা ও স্বামীর সাহায্যে সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
শিপ্রা দাসের জন্ম হয় ঢাকা হলি ফ্যামিলি হাসাপাতালে। তখন তার বাবা কাজ করতেন ব্রিটিশ হাই কমিশনে। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন তেজগাঁওয়ের বটমলী হোমস বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালেই ইঞ্জিনিয়ার ডেভিড দাসের সঙ্গে শুভ পরিণয় ঘটে। বিয়ের পরে এসএসসি পাস করেন। এরপর ইন্টারমিডিয়েট ও বিএ পড়াশোনা সম্পন্ন করেন তেজগাঁও মহিলা কলেজ থেকে। স্বামী ডেভিড শিপ্রা দাসকে বললেন, ‘তুমি চাইলে ‘আইন’ নিয়ে পড়াশোনা করতে পারো’। আমি তোমাকে সাহায্যে করবো। এর পর ঢাকার আইডিয়াল ল’ কলেজ থেকে এলএলবি সম্পন্ন করেন।
বাবা এবং স্বামী শিক্ষিত থাকার কারণে সেই সময়ে পড়াশোনার জন্য পরিবার থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। ঢাকা জেলার দোহার নবাবগঞ্জ উপজেলার (আঠারোগ্রাম অঞ্চল) নয়নশ্রী ইউনিয়নের দেওতলা গ্রামে পৈত্রিক নিবাস। পিতা পিউস ওয়াল্টার গমেজ গান করতে পছন্দ করেতেন। সেইসঙ্গে গ্রামে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অভিনয় করেছেন। বাবাকে দেখে নিজেও অভিনয় করতে করতে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত অভিনয় শিল্পীদের মধ্যে একজন শিপ্রা।
একটি প্রচলিত ধারণা আছে উকিলেরা সত্যকে মিথ্যা বানায় এবং মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রমাণিত করে। এই প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে শিপ্রা বলেন, ‘আমার কাছে যখন আমার ক্লায়েন্ট আসে একটি মামলা নিয়ে তখন তার ভাষ্য অনুসারেই আমাকে মামলা সাজাতে এবং কোর্টে জজ সাহেবের সামনে সেইভাবেই উপস্থাপন করতে হয়। উপস্থাপন করার পর বিপক্ষের আইনজীবী এবং সাক্ষীর বয়ান থেকে কিছু অংশ জানা যায়। সবসময় আইনজীবীরা সরেজমিনে যেতে পারেন না। সব তথ্যের প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করে থাকি কোনো মামলা গ্রহণ করার পূর্বে মামলার বিষয়টি যাচাই-বাছাই করার। আইনের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আইজীবী হিসেবে একটি মামলা গ্রহণ করার পর প্রত্যেকেই জয়লাভ করতে চায়’।
শিপ্রার কোনো স্বপ্ন ছিলো না বড় হয়ে কোনো কিছু হওয়ার। কিন্তু নিজ চেষ্টা, যোগ্যতায় এবং স্বামীর সহযোগিতায় ২০১৯ সালের ১৭ অক্টোবর ‘হাইকোর্টের লিগালএইডের প্যানেল ল’য়ার হিসেবে বাংলাদেশের প্রথম খ্রিস্টান নারী হিসেবে নিয়োগের চিঠি হাতে পান। এদিনের অনুভূতি জানতে চাইলে শিপ্রা দাস বলেন, আমি কোনোদিন চিন্তা করেনি এবং আশাও করিনি এই স্থানে আসতে পারবো। ঈশ^রের আশীর্বাদে এবং স্বামীর অনুপ্রেরণায় আমি এখানে উপনীত হয়েছি। আমার হাতে চিঠি প্রদানের পরে যখন বলা হলো যে আপনি ‘হাইকোর্টের লিগালএইডের প্যানেল ল’য়ার হিসেবে বাংলাদেশের প্রথম খ্রিস্টান নারী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছি সেই অনুভূতি বলে বোঝার নয়। আমি অনেক আনন্দিত হয়েছিলাম’। নারী সমাজের উদ্দেশ্যে শিপ্রা বলেন, অতীতে নারীরা অনেক পিছিয়ে থাকলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহায়তা প্রদানের কারণে নারীরা জাতীয় সংসদের স্পিকারও হয়েছেন। আইনগত দিক থেকে অনেক নারী বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার হলেও ভয়ের কারণে অনেক নারী মামলা করেন না। নারীদের জন্য বিনা খরচের মামলার সুবিধা রয়েছে। যা অনেক সচেতন নারীরাও জানে না। ইঞ্জিনিয়ার স্বামী এবং সন্তানদের নিয়ে ঢাকার কাফরুলে নিজ বাড়িতে ব্যস্ত সময় কাটান। পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের আইনি পরামর্শ প্রদান করে থাকেন। নারী সংগঠন ওয়াইডাব্ললিওসিএ’র ‘লিগ্যাল অ্যাডভাইজার’ হিসেবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন সময়ে নারীদের সচেতনতার জন্য বিভিন্ন সেমিনার প্রদান করেছেন তা বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে।