আহসান হাবিব : স্বাধীনতা মানুষের প্রধান আকাক্সক্ষা, পরাধীনতা তার বাস্তবতা। কেন? কারণ সহজ, সে একাকী নয়, সে বাস করে আর সবার সঙ্গে এবং সে অন্যের সঙ্গে একটা সুনির্দিষ্ট সম্পর্কে জড়িত। এই সম্পর্কই নির্ধারণ করে দেয় তার নানাবিধ স্বাধীনতার মানদ-। এটা কেউ ইচ্ছা করে করে না, সম্পর্কের রূপটাই এটার অলক্ষ্য পরিচালক। এভাবে আমরা একটা রাষ্ট্র নির্মাণ করি এবং এই রাষ্ট্র তার সুবিধার জন্য, তার টিকে থাকার জন্য একটা সতত পরিবর্তনশীল মানদ- নির্ধারণ করে, সেটা সবাইকে মেনে চলতে উপর থেকে চাপ দিতে থাকে। সে এখানে যেহেতু থাকতে বাধ্য, তার অস্তিত্বের প্রশ্নে সে একটা উৎপাদন সম্পর্কেও জড়িত, কিন্তু তার যে আকাক্সক্ষা স্বাধীনতা, সে দেখতে পায় সেগুলো প্রতি পদে পদে খ-িত হয়ে পড়ছে। তখন তার ভেতরে একটা পরাধীনের মনস্তত্ত্ব এসে হাজির হয়ে পড়ছে এবং এটাকে সে ভাঙতে চেষ্টা করছে। এই চেষ্টার রূপ নানাবিধ, পারিবারিক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রিক। এটা একটা লড়াই এবং নিরন্তর চলতে থাকে। এটা এক মানুষের সঙ্গে আরেক মানুষের লড়াই, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সামাজিক মানুষের লড়াই, এটা আন্তঃলড়াই।
অন্য একটি লড়াই আছে, জেন্ডারভিত্তিক লড়াই যা নারী এবং পুরুষের মধ্যে হয়। এর বাইরের দিক হচ্ছে লিঙ্গ, ভেতরে ওই উৎপাদন সম্পর্ক অর্থাৎ এই সম্পর্কে কে কাকে অধঃস্তন রাখছে তার উপর। যে নারী অর্থনৈতিকভাবে পুরুষের চেয়ে অধিকতর সুবিধার মধ্যে আছে, সেই নারী পুরুষকে ডমিনেট করবে, এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু লিঙ্গ ভেদ হওয়ার কারণে মানে সে নারী হওয়ার কারণে ওই পুরুষকে সে ডমিনেট করতে পারে না, বরং উল্টো হয়। এটা পুরুষতন্ত্রের একটা জোরের দিক। রাষ্ট্র সব মানুষের উপর তার ডমিনেট জারি রাখে, কিন্তু পুরুষ রাখে নারীর উপর। এই আধিপত্যবাদ নারী এবং পুরুষের অন্তঃলড়াই। এটা চলে আসছে এবং এর রূপ নানাভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। এই লড়াইয়ে নারীর দুটি প্রতিপক্ষ একটি পুরুষ, অন্যটি রাষ্ট্র, কেননা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে রাষ্ট্র নিজেই পুরুষবাদী। তবে রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখার খাতিরে সে নারীবান্ধব কিছু আইন বানায় যা একধরনের চাপিয়ে দেওয়া শক্তি, প্রকৃত স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা নয়, ফলে নারী এই সুবিধা ভোগ করতে স্বস্তি পায় না এবং সবসময় অধঃস্তনতার বোধ অনুভব করতে থাকে। রাষ্ট্র যেহেতু পুরুষবাদী, তাই এর সংস্কৃতি পুরুষবান্ধব এবং উৎপাদন ব্যবস্থা যেহেতু পুঁজিবাদী, তাই বৈষম্যমূলক এবং সম্পদের এই বৈষম্য জারি থাকে যেখানে নারী বঞ্চিতের দলে নাম লেখায়। ফলে নারী দু’ভাবে পরাজিতের বেদনা বয়ে বেড়ায়, এক. সে নারী, দুই. সে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অধীন। পুঁজিবাদের একটা প্রধান দিক হচ্ছে সব কিছুকে পণ্যায়িত করা।
নারীকেও করে, পুরুষকেও করে, কিন্তু নারীকে সে তার শুধু শ্রমের দিক থেকে করে না, করে যৌনতার দিক থেকে, নারী দেহকে সে যৌন বস্তু বানিয়ে ফেলে। যে নারী এবং পুরুষ শ্রমিক একই জায়গায় একই কাজ করে, একই দেহ প্রদর্শন করে কিংবা করে না, সেখানে নারীর দেহের উপর তার চোখ পড়ে এবং সেই চোখ যৌন চোখ। নারী যেহেতু অধীনস্ত, তাই সে চেষ্টা করে পুরুষের এই যৌন চোখ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে, তখন সে নিজের শরীর নানা উপায়ে ঢাকতে চেষ্টা করে। যদিও কোন ঢাকনা দিয়েই রক্ষা পায় না। পুরুষ যেহেতু ডমিনেটর, তাই সে নারী দেহ নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করে, সে যে মানদ- নির্ধারণ করে দেয়, তাই নারী করতে বাধ্য থাকে। রাষ্ট্র এবং পুরুষতন্ত্র নারীর দেহকে যৌন পণ্য যা পুরুষের কাছে সবচেয়ে আকাক্সিক্ষত, তা তুলে ধরে এবং মুনাফা লুটতে থাকে। সমাজের বা রাষ্ট্রের কিছু নারী এর প্রতিবাদ করে, তারা নারী দেহকে নারীর ইচ্ছাধীন রাখার সংগ্রাম করে এবং তার দেহকে কীভাবে তুলে ধরবে তার এখতিয়ার সম্পূর্ণ তার। শুরু হয় লড়াই, এই লড়াইয়ের ফলে নারীরা অনেক কিছু জয় করেছে। এই লড়াইয়ের ইতিহাস তাই বলছে। এই লড়াইয়ে নারীকে লড়তে হচ্ছে দুটি শক্তির বিরুদ্ধে, আগেই বলেছি পুরুষতন্ত্র এবং রাষ্ট্র, ফলে এই লড়াই কঠিন লড়াই।
পুরুষ যে নারী দেহকে যৌন বস্তু আখ্যায়িত করে, তার কারণ একটাই ডমিনেশন। কারণ উভয়ের দেহই প্রাকৃতিকভাবে নির্মিত, যৌনতা দরকার শুধু তার টিকে থাকার জন্য। এর মধ্যে মানুষই কেবল এই যৌনতাকে ডমিনেশনের হাতিয়ার করেছে। তাদের স্তনকে, তাদের নিতম্বকে, তাদের গ্রীবাকে, তাদের কেশকে এমনভাবে তুলে ধরেছে পুরুষ যে, তা নারীর জন্য বিব্রতের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, পুরুষ হয়েছে এর ক্রেতা। আগেই বলেছি যেহেতু তারা নানাভাবে ডমিনেটেড, তাই এসব মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। পুরুষ তার জয়পতাকা উড়িয়ে চলেছে গায়ের জোরে। নারীর লড়াই দুটি : পুঁজিবাদ এবং পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। নারীকে নিয়ে পুরুষ যতো জার্গন তৈরি করেছে, সব নারীকে অধঃস্তন বানিয়ে রাখার লক্ষ্যে। পুরুষ পরাধীন একবার, নারী অন্তত দু’বার। পুরুষের প্রধান বিভ্রম নারীদেহ। নারীর লড়াই এই চাপিয়ে দেওয়া বিভ্রমের বিরুদ্ধে। ফেসবুক থেকে