মোঃ আবুল ফজল মীর: এখনো মানবতা একবারে উড়ে যায়নি। জাগতিক চরম হতাশার মধ্যেও কারো কারো মানবতা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে সারা বিশ্বের কাছে। ২০১৫ সালের অসাধারণ এক উদ্যোগ আজ প্রশংসিত দেশবাসীর কাছে। খোদ রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রামের আনাচে-কানাচে এখন গড়ে উঠছে ‘মহানুভবতার দেয়াল’
মহানুভবতার দেয়াল ধারণাটি প্রথম দেখা গিয়েছিল ইরানের মাশাদ নামের একটা শহরে।সেখানে শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র পৌঁছে দিতে অজ্ঞাত কোন এক ব্যক্তি এমন অভিনব উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সেবারই প্রথম এরকম কিছু দেখেছিল সারাবিশ্বের মানুষ। সেই উদ্যোগের নাম দেয়া হয়েছিল ‘মহানুভবতার দেয়াল।’ ইরান ও আন্তর্জাতিক অনেক সংবাদ মাধ্যমই তখন খবরটা ফলাও করে ছেপেছিলো।
চমৎকার, অভিনব ও মহৎ এই উদ্যোগ তরুণ প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিতে কুমিল্লা জেলার সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে নতুনভাবে। আর শিক্ষার্থীরাও এই মহৎ কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করে দারুণভাবে তৃপ্ত হচ্ছে। তাঁদের অপ্রয়োজনীয় জামা ও অন্যান্য জিনিসপত্র রাখছে ‘মহানুভবতার দেয়ালে’। একজনের কাছে যা তুচ্ছ-অপ্রয়োজনীয়, অন্যজনের কাছে সেটাই হয়তো মূল্যবান। কেউ যেটা ময়লার ঝুঁড়িতে ফেলে আবর্জনা হিসেবে, সেটাই কারো কাছে হয়ে ওঠে কাঙিক্ষত বস্তু।
আমাদের দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষই অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষই কৃষিজীবী। কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন তারা। অভাব অনটনেই চলে তাদের জীবন। এসব দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের করে পড়ালেখা করতে হয়। অনেক পরিবারের ছেলে-মেয়েরা একবেলা কাজ করে স্কুলে যায়। আবার স্কুল থেকে ফিরে এসে কাজ করে। এসব পরিবারে সন্তানরা ভালো পোশাক পরে স্কুলে যেতে পারে না। সাধ থাকলেও ভালো পোশাক কেনার সাধ্য তাদের থাকে না। ফলে পুরোনো ও ছেঁড়া জামা-কাপড় পরে এসব শিশুদের যেতে হয় স্কুলে। এই মহৎ উদ্যোগের ফলে দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা পাবে ভাল জামা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রবাদি যা দিয়ে তাদের সাধের কিছুটা হলেও পূরণ হবে।
আমরা সবাই জানি আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। শিশু জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। শিশুদের ভাল করতে হলে তাদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হলে, তাদের সুখী করতে হবে। আনন্দের মাঝেই শিশুর শিক্ষা জীবনের অবস্থান। অভাব, অনটন, প্রতিকূল পরিবেশ, শিশুর শিক্ষা জীবনকে অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দেয়। শিশুর মনের আনন্দই তার দেহ মনের শক্তির মূল উৎস। আনন্দ ও শিশু বান্ধব পরিবেশ ছাড়া তার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ অসম্ভব। আর সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে আমরা আমাদের সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুরু করেছি সহনশীলতা, সহমর্মিতা অনুশীলনের এক মহান ধারণা ‘মহানুভবতার দেয়াল’।
আমরা একটা স্বপ্নের বাংলাদেশের কল্পনা করি।প্রধানমন্ত্রী সেই স্বপ্নের বাংলাদেশের রূপকল্প ২০৪১ আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। সেই ধরণের দেশ যদি গঠন করতে হয় তাহলে সেই ধরণের মানুষ প্রয়োজন। উন্নত বাংলাদেশ গড়তে শিশুদের মধ্যে মেধা, দেশাত্ববোধ ও মূল্যবোধ জাগ্রত করার উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। শিশুদের মধ্যে মনন তৈরি ও দেশাত্ববোধ, মূল্যবোধ জাগ্রত করার জন্য স্বপ্ন দেখাতে হবে। জীবনটা হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র, এই যুদ্ধে জিততে হলে স্বপ্ন দেখতে হবে। জীবন চলার পথে অনেক আচ্ছাদন হারিয়ে যাবে, তাতে থেমে গেলে চলবেনা। স্বপ্নের ঠিকানায় পৌঁছাতে হলে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে, স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি যদি বাস্তবায়নের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা থাকে তাহলে অনেক স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব। আর সেটা সম্ভব মহানুভবতার দেয়ালের মাধ্যমে।
উন্নত দেশের প্রস্তুতি হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো বেশি ফলপ্রসু করা এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে কুমিল্লা জেলাপ্রশাসন প্রাথমিক শিক্ষাকে কেন্দ্র করে দশটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কুমিল্লা জেলার আওতাধীন প্রতিটি প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আরো বেশি সমৃদ্ধশালী ও দৃষ্টিনন্দন করতে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার, লাইব্রেরী, সততা স্টোর, মহানুভবতার দেয়াল, ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, সুসজ্জিত শ্রেণিকক্ষ, ফুলের বাগান, দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ, আমার বিদ্যালয় আমি পরিস্কার রাখি এবং মায়ের দেয়া খাবার খাই এই দশটি উদ্যোগের বাস্তবায়ন কাজ চলমান রয়েছে।
‘মানুষ মানুষের জন্যে’ কিংবা ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রবাদ বাক্যগুলোর বাস্তব রূপ দিতে আসুন আমরা সবাই একসাথে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে হাতে হাত ধরে কাজ করি। মহতি এই উদ্যোগের সাথে জড়িত সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এই মহৎপ্রাণ মানুষগুলোর জন্যেই বারবার আমরা স্বপ্ন দেখার সাহস পাই।
লেখক, জেলাপ্রশাসক, কুমিল্লা।