মাজহারুল ইসলাম : অধ:স্তন আদালতের বিচারকদের আর্থিক এখতিয়ার বাড়িয়ে ১৩২ বছরের পুরনো আইন ২০১৬ সালে সংশোধন করে সরকার। ফলে উচ্চ আদালত থেকে প্রায় ১০ হাজার দেওয়ানি মামলা অধস্তন আদালতে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেয় সুপ্রিমকোর্টের তৎকালীন প্রশাসন। কিন্তু উচ্চ আদালতের কতিপয় আইনজীবী মামলা অধস্তন আদালতে ফেরত প্রদান ঠেকাতে সংশোধিত আইন চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন। রিটের শুনানি নিয়ে সংশোধিত আইনের কার্যকারিতা স্থগিত করেন হাইকোর্ট। আমাদের সময়
এরপর তিন বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও বিধানটি আটকে আছে স্থগিতাদেশেই। ফলে ১৩২ বছরের পুরনো দেওয়ানি আদালত আইনের অধীনেই চলছে দেওয়ানি মামলার বিচার। ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বিচারপ্রার্থীদের। অনেক কম আর্থিক মূল্যমানের মামলাতেও উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে বিচারপ্রার্থীকে। ফলে মামলা পরিচালনা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। হয়রানির শিকার হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা।
এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আমরা এটির আশু সমাধান চাই। সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের যে আপত্তি সেটি নিয়ে তাদের সঙ্গে বৈঠক করবো। জানা গেছে, দেওয়ানি আদালত আইন ১৮৮৭’ অনুযায়ী জমিজমা ও অফিসসংক্রান্ত বিরোধের ক্ষেত্রে মামলার মূল্যমান এক টাকা থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত হলে বিচার হবে সহকারী জজ আদালতে। দুই লাখ এক টাকা থেকে চার লাখ পর্যন্ত সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে এবং মামলার মূল্যমান চার লাখ টাকার ওপরে হলে তার বিচার হবে যুগ্ম জেলা জজ আদালতে। তবে আপিল মামলার ক্ষেত্রে মামলার মূল্যমান ৫ লাখ টাকার ওপরে হলেই বিচারপ্রার্থীকে হাইকোর্টে আপিল বা রিভিশন মামলা করতে হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রায় দেড়শ বছর আগের জমির মূল্যমানের সঙ্গে বর্তমান মূল্যমানের আকাশ-পাতাল ফারাক। সঙ্গত কারণেই ১৩২ বছর আগের দেওয়ানি আদালত আইন বর্তমান প্রেক্ষাপটে অচল। কারণ দেশের যে কোনো শহরেই এখন এক শতাংশ জমির মূল্য কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা। ফলে এক শতাংশ জমি নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হলেই আপিল মামলার ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীকে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। কারণ জেলা জজ পাঁচ লাখ টাকার অধিক মূল্যমানের মামলা শুনানির এখতিয়ার রাখেন না।
এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে ২০১৬ সালের এপ্রিলে আইনটি সংশোধন করে সরকার। ‘সিভিল কোর্টস (অ্যামেন্ডমেন্ট) সংশোধন আইনের ৪(৩) ধারায় বলা হয়, দেওয়ানি মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে সহকারী জজ সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা মূল্যমান, সিনিয়র সহকারী জজ ২৫ লাখ টাকা এবং জেলা জজ ৫ কোটি টাকা মূল্যমানের মামলা গ্রহণ করতে পারবেন। আইন কার্যকর হওয়ার পরে হাইকোর্টে বিচারাধীন সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা মূল্যমানের মামলা ৯০ দিনের মধ্যে জেলা জজ আদালতে স্থানান্তরিত হবে। সংশ্লিষ্ট জেলা জজ তা নিষ্পত্তি করবেন। তবে যেসব মামলার শুনানি শুরু হয়েছে, তা হাইকোর্টেই থাকবে। অর্থাৎ হাইকোর্টে আপিল বা আংশিক শুনানির পর্যায়ে রয়েছে, তা নিত্ব্য আদালতে স্থানান্তরিত হবে না। আইন সংশোধনের পর সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন থেকে প্রায় ১০ হাজার মামলা বাছাই করে তা অধস্তন আদালতে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়।
এ অবস্থায় উচ্চ আদালতের আইনজীবীরা এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় সংশোধিত আইনের ৪(৩) ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন ব্যারিস্টার সাইদুল আলম খানসহ চার আইনজীবী। রিটে সংশোধিত আইনের ৪(৩) ধারা সংবিধানের ৩১, ১০৯, ১০১, ১৪৯ ধারার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে দাবি করা হয়। এর পর আইনটি সংশোধনের দুই মাসের মধ্যে ২০১৬ সালের ১৬ জুন রুল জারির পাশাপাশি সংশোধিত আইনের কার্যকারিতা স্থগিত করেন হাইকোর্ট। এর পর থেকে এ পর্যন্ত স্থগিতই রয়ে গেছে সংশোধিত আইনের কার্যকারিতা। রাষ্ট্রপক্ষও ওই স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে কোনো আবেদন করেনি।
আইনজ্ঞরা বলছেন, সংশোধিত দেওয়ানি আইন কার্যকর থাকলে ছোট ছোট দেওয়ানি মামলা, যেগুলোর আর্থিক মূল্যমান কম সেগুলো নিয়ে বিচারপ্রার্থীদের হাইকোর্টে আসার প্রয়োজন হতো না। নিত্ব্য আদালতেই তাদের মামলা নিষ্পত্তি হতো। এতে মামলাজট কমার পাশাপাশি বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগও অনেকাংশে হ্রাস পেত। এক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, ‘সত্যি কথা হচ্ছে, মানুষের কথা চিন্তা করলে, বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ হ্রাসের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে ওই সংশোধনীটি যথাযথই ছিল। অধস্তন আদালতের বিচারকদের আর্থিক এখতিয়ার বাড়িয়ে দিলে মানুষকে কষ্ট করে হাইকোর্টে আসতে হতো না।
এজেডপি