আহসান হাবিব : আদর্শে অবিচল থাকা কঠিন এক ব্রত। জীবন যতো এগিয়ে চলে, সারল্য মিলিয়ে জটিলতা জাপটে ধরে। এই জটিলতা নানা বেশে আসে। গড়ে ওঠা দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে থাকে। শৈশব যে চৈতন্য গড়ে দেয়, তার উপর জীবনের ঝড় বইতে থাকে। সেই ঝড় নতুন নতুন দিক উন্মোচন করে দেয়। মূল চৈতন্যের উপর এর অভিঘাত বিশাল। এই অভিঘাত মূল আদর্শকে বদলে দিতে পারে এবং দেয়ও। তবে এই বদল যদি হয় আদর্শভিত্তিক আরও উন্নততর অভিমুখী, জীবন সুন্দর হয়। আমাদের শৈশব সাম্প্রদায়িক চেতনার আবহে গড়ে ওঠে। সব কিছুতে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার একটা অলিখিত কঠিন নির্দেশনা ঘিরে থাকে শিশুর মন। এই অনুশাসনগুলো শিশুর মনকে একটা ভয়ের মধ্যে ফেলে রাখে। মুক্তচিন্তা এবং সহজাত প্রাণজ
বৈশিষ্ট্যগুলো অবদমিত হতে থাকে। একটা অদৃশ্য শক্তির ভয়ে কাঁপতে থাকে শিশুর মন। তখন যা কিছু গড়ে ওঠে তা ঠিক আদর্শ নয়, কিছু বৈশিষ্ট্য। শিশু যতো বড় হতে থাকে বদলাতে থাকে তার মনন। তার চিন্তার পরিধি বাড়তে থাকে। সে নিজেকে চিনতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। একটা ‘আমি’ জেগে ওঠে। তখন সে শৈশবে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যগুলো কাটাছেঁড়া করতে থাকে। সে অনেক কিছু নাকচ করতে থাকে। সময় যতো এগিয়ে চলে, জানাশোনা যতো বাড়তে থাকে, দার্শনিক বিষয়গুলো যখন সে বুঝতে শেখে এবং ধারণ করার মতো পারঙ্গম হয়ে ওঠে, একটা আদর্শ রূপ নিতে থাকে। মূল প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় সে কোনদিকে যাবে? জগতকে সে ব্যাখ্যা করতে শুরু করে। সে দেখতে পায় পরিষ্কার দুটো দিক, একদিকে রয়েছে ইহজাগকিকতা, অন্যদিকে পারলৌকিকতা। যেকোনো একটি তাকে বেছে নিতে হয়। সে যা বেছে নেয়, এটাই তার দার্শনিক অবস্থান। এটা তার আদর্শের একটি মৌলিক দিক হয়ে ওঠে। এই অবস্থান থেকেই সে জগতকে দেখতে থাকে এবং মানুষের সঙ্গে, পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে।মোটা দাগে এই চেতনাই তাকে জীবনের আর যা কিছু আছে সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে ভূমিকা পালন করে। তখন তার সামনে এসে দাঁড়ায় তার টিকে থাকার প্রশ্নটি। এটি কঠিন এক সংগ্রাম। এই সংগ্রামে থেকে যুক্ত থাকতে হয় উৎপাদন সম্পর্কে, এটাই তার শ্রেণি অবস্থান ঠিক করে দেয়। এই শ্রেণি অবস্থানই তার চৈতন্যকে চালিত করতে থাকে। শ্রেণি সম্পর্ককে সে তার জানাশোনা দিয়ে বিচার করতে বসে। বিচারে সে দেখতে পায় বিশাল এক ফাঁক, এই সম্পর্কের মধ্য দিয়েই মানুষের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য পরিষ্কার হয়ে ওঠে। সে তখন রাজনৈতিক সচেতন হয়ে ওঠে এবং সে একটি পক্ষ বেছে নেয়। এটাই তার মূল আদর্শ হয়ে ওঠে। কেননা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিই আদর্শের মূল ভিত্তি এবং এটাই তার সামাজিক আইডেন্টিটি। আমি এই আদর্শে অবিচল থাকার কথা বলছি। বলছি এটা কঠিন এক ব্রত। দেখা যায় খুব কম লোক পারে অবিচল থাকতে, যারা পারে তারাই পৃথিবীকে বদলায়, সুন্দর করে, তারাই নমস্য যুগে যুগে। ফেসবুক থেকে