মাহফুজ নান্টু: টাকা ছাড়া চাকরি! শুধু পুলিশে কেন, যেকোন চাকরির নিয়োগেই টাকা লাগে, এমনটি ধারণা সকলের। সরকারি চাকরিও এর ব্যতিক্রম নয় । একটি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ বছরের সে অনিয়মটা ভেঙে দিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম বিপিএম (বার), পিপিএম।
কুমিল্লায় মেধা, যোগ্যতা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল পদে চাকরি পেয়ে গার্মেন্টসকর্মী, গৃহকর্মী, দিনমজুর, সবজিবিক্রেতা, কৃষক, ভ্যান ও রিকশা চালক, পোষ্য ও মুক্তিযোদ্ধার মেধাবী সন্তানদের বুকে কষ্ট ছাপিয়ে চোখ চুঁইয়ে পড়ছে আনন্দ অশ্রু।
এক নিয়োগেই শতভাগ স্বচ্ছতা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে মেধাবীদের মূল্যায়ন করলেন পুলিশ সুপার। ঘুষ-লবিং-তদবির ছাড়াই মেধার ভিত্তিতে ৩০৭ জনকে কনস্টেবল পদে চাকরি দিয়ে অসাধারণ মাইলফলক স্থাপণ করে নিজের দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলেন কুমিল্লা পুলিশ সুপার।
নিয়োগ প্রাপ্তদের মধ্যে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার দূর্গাপুর গ্রামের হারুন মিয়ার মেয়ে আছমা আক্তার জানান, কয়েক বছর আগে তার বাবা দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে বাড়িতেই থাকেন। বাবা-মা ও ৬ বোনের সংসারে তার মায়ের ১৮০ টাকা দৈনিক মজুরি পরিবারটির ভরণ-পোষনের একমাত্র অবলম্বন। সম্পত্তি বলতে একটি ছাপড়া ঘর। আছমার কণ্ঠে শোনা যায়, "১০৩ টাকায় চাকরি পাবো তা জীবনেও কল্পনা করিনি।"
একই উপজেলার পশ্চিম মাঝিগাছার অভাবী সংসারের বড় সন্তান মেহেদী হাসান। নগরীতে সেনিটারি মিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালিয়ে আসছিলো। মাত্র ১০৩ টাকায় চাকরী পেয়ে আবেগে অঝোড়ে কান্না করে। বাবা রফিকুল ইসলাম বেকার। পুরো সংসারটা চালাতে হয় মেহেদী হাসানকে। পুলিশে চাকরি পেয়ে সবার সামনেই কাঁদতে থাকে মেহেদী হাসান।
জেলার বরুড়া উপজেলার ঝিকুটিয়া গ্রামের মোকশত আলীর মেয়ে তাছপিয়া জাহান প্রিয়াংকাও চোখের পানি আড়াল করতে চেয়েও পারে নি। কিভাবে আনন্দ প্রকাশ করবে বুঝতে পারছিলো না। বাবা গত হয়েছেন অনেক দিন। মা ক্যান্সারে ভুগছেন। টাকার অভাবে যথাযথ চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছিলো না। ৫ বোন ও ১ ভাইয়ের সংসারের ভরণ পোষণ কতটা কষ্টের তা প্রিয়াংকার মুখ থেকে না শুনলে কেউ বিশ্বাস করবে না। পেটে ক্ষুধা নিয়েও হাসিমুখে কতদিন যে পার করেছে প্রিয়াংকা ও তার ভাইবোন এর কোন হিসেব নেই। এ চাকরিটা তার জন্য সোনার হরিণের মতোই।
ছয় বছর আগে বাবা মারা যায়। চোখেমুখে অন্ধকার দেখে রবিউল। বাঙ্গুরাবাজার থানার নবীয়াবাদ গ্রামের বাবা হারা কিশোর রবিউল আউয়াল জানায়, "বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে প্রতিনিয়ত অভাবের সাথে যুদ্ধ করে চলছি। এ সময় খবর এলো ১০৩ টাক খরচে পুলিশে লোক নিবে। আস্থা নিয়ে আবেদন করি, তবে বলতে গেলে বিনা টাকায় চাকরি পাবো কখনোই কল্পনা করিনি"। বলেই নিকট অতীতের কষ্টগুলো মনে এনে হাউমাউ করে কান্না করছিলো। এ কান্না একটু সুখে থাকার কান্না, এ কান্না দীর্ঘ বছর অভাব থেকে মুক্তি পাবার কান্না।
আর্থিক অনটনের সংসারে মায়ের অনুপ্রেরণায় গার্মেন্টস-এ চাকুরীর পাশাপাশি নিজের লেখাপড়া চালিয়ে যায় কাজল রেখা সোমা। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ডিগ্রিতে পড়ুয়া কাজল রেখা সোমা পুলিশে নিয়োগ হবে শুনে মায়ের উৎসাহে কুমিল্লা পুলিশ লাইনস্ মাঠে এসে দাঁড়ায়। প্রাথমিক যাচাই বাছাইয়ে উত্তীর্ণ হয়ে অংশগ্রহণ করে লিখিত পরীক্ষায়। লিখিত পরীক্ষাতেও সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয় সে। মৌখিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত সোমা। কারণ গার্মেন্টস থেকে ছুটি পায়নি। এ খবর চলে যায় কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলামের কাছে। তিনি জানতে পারেন কাজল রেখা সোমা যে গার্মেন্টস-এ চাকুরী করে সেখানকার ম্যানেজার ছুটি দিতে নারাজ। পরে পুলিশ প্রশাসন থেকে ফোন গেলে ছুটি দেয় তাকে। মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেয় সোমা। পেয়ে যায় বহুল কাঙ্খিত চাকরি।
মুরাদনগরের পপি নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এসএসসি পাশ করে৷ অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে পপির মা। বাবা ইদ্রিস মিয়া পক্ষাঘাতগ্রস্থ। মায়ের পরিশ্রমে এইচএসসি পরীক্ষা দেয়। আর কিছু দিন পরে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল দেবে। তবে তার মাঝেই কিছু করে মায়ের দুঃখ কষ্ট দূর করতে চায় পপি। সুযোগ আসে পুলিশের চাকরির। ৫ ভাই ৩ বোন মিলে এত বড় পরিবারে পপির ভাই বোনদের অভাব অনটন লেগেই থাকতো। মাত্র ১০৩ টাকায় পুলিশে চাকরি পেয়েছে। অনুভূতি জানাতে পপি যখন মাইক্রোফোনে কথা শুরু করে তখন পাশে দাঁড়ানো মা। কথা বলার মাঝেই চাকরি পাবার আনন্দে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে পপি। পপির কান্নার সাথে যোগ দেয় তার মা। আনন্দে চোখ মুছেন। তবে সামনে বসে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা-সংবাদকর্মীদের গাল বেয়ে পড়ছিলো মায়ের দুঃখ দূর করার পথে এগিয়ে যাওয়া এক অদম্য কিশোরীর জীবনের গল্প শুনে। মঞ্চে মা মেয়ের একসাথে আনন্দাশ্রুর দৃশ্যটি উপস্থিত সবার মাঝে আন্দোলিত করে।
অভাব কতটা প্রকট হতে পারে তা যেন স্ববিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করলো ভাইভা বোর্ডে উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তারা লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ জেলার মুরাদনগর উপজেলার হিরারকান্দা গ্রামের সিএনজি চালক ইউনুস মিয়ার মেয়ে লিজা আক্তারও একই উপজেলার কড়ইবাড়ী গ্রামের কৃষক সোনালী মিয়ার ছেলে আশরাফুল ইসলামকে দেখে। টাকার অভাবে জুতা কিনতে না পেরে বাড়িতে ব্যবহার করা স্যান্ডেল পড়েই ভাইভা বোর্ডে এসেছিলো। জেলা পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম স্যান্ডেল পরে ভাইবা বোর্ডে আসার নেপথ্যর ঘটনা জানতে চাইলে আশরাফুল ও লিজার চোখে পরিবারের অক্ষমতার চিত্র টলটল করে উঠে। আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগে পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম নিজেই আবেগ সংবরণ করতে রুমাল বের করে চোখ ঢাকেন। একদল অদম্য মেধাবীকে কাছে পেয়ে তিনি যেন নতুন এক প্রত্যয়ে জ্বলে উঠেন।
সূত্র জানায়, পুলিশ সুপারের সততা, স্বচ্ছতা, ও দয়িত্বাপূর্ণ নিরপেক্ষতার কারণে কুমিল্লা জেলায় উত্তীর্ণ ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল নিয়োগের ফলাফল কুমিল্লা জেলাবাসীর মাঝে বেশ প্রশংসিত হয়েছে।
কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম জানান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং মান্যবর আইজিপি স্যারের নির্দেশেনা যথাযথভাবে বাস্তবায়নে শতভাগ সচেষ্ট থেকেছি"।
আপনার মতামত লিখুন :