শিরোনাম

প্রকাশিত : ২১ মে, ২০১৯, ০৪:৪৯ সকাল
আপডেট : ২১ মে, ২০১৯, ০৪:৪৯ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

আবর্জনায় বিপর্যস্ত পাহাড়ের পরিবেশ, বর্ষায় রোগ বালাইয়ের শঙ্কা

নিজস্ব প্রতিবেদক: সবুজের আচ্ছাদন ক্ষয়ে উখিয়ার পাহাড়ে জমছে ধুলো-বালি আর গৃহস্থালি বর্জ্য। আটোসাটো ঝুপড়ি ঘর আর অসচেনতায় ছড়াচ্ছে দূষণ। ব্যবহার নিষিদ্ধ পলিথিন আর উচ্ছিষ্টে বাধা পড়ছে পাহাড়ি জলধারার গতিপথ।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মারাত্মক আকার ধারণ করছে, বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণ। অধিবাসীদের অসচেতনতায় দূষণ ছড়াচ্ছে চারপাশে। চিকিৎসকরা বলছেন, ক্রমবর্ধমাণ এই দূষণ ডেকে আনছে বাসিন্দাদের অ্যাজমা, ক্রনিক ব্রণক্রাইটিস আর ফুসফুসের নানান সংক্রমন।

উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ পেরুলেই মূল রাস্তা। পাহাড়ি টিলার ভেতর দিয়ে একে বেঁকে যাওয়া সেই রাস্তা ধরে এগুলোই রোহিঙ্গা ক্যাম্প। শুষ্ক মৌসুমে এ পথের বিভিন্ন অংশে নির্মাণ হচ্ছে কালভাট। কোথাও কোথাও চলছে রোহিঙ্গাদের সেবায় বাজার সম্প্রসারণে খোঁড়াখুড়ি। পথের দুধারেই ছোট-ছোট টং দোকান। তাতে বিক্রি হচ্ছে চাল-ডাল, মাছ-মাংস, তরিতরকারি। মিলছে গৃহস্থালির ব্যবহার্য্য পণ্যও।

এই ক্যাম্পে বাস করছেন ১০ হাজর রোহিঙ্গা। এদের সহায়তায় প্রতিদিনই এখানে আসছেন আরো শতাধিক উন্নয়ন কর্মী। স্বল্প জায়গায় বৃহৎ এ জনগোষ্ঠি প্রতিদিন কি পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদন করছে, সে হিসেব নেই। নেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোন বন্দোবস্ত। তাহলে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে-এসব বর্জ্যের গন্তব্য কোথায়?

উখিয়ার কুতুপালং গ্রামের ২৪ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা নূর-সাফা। সকাল বেলায় দেখা মিললো এই গৃহিনীর। ঝাড়ু হাতে দিনের শুরুতেই ঘরদোর পরিষ্কার করছিলেন তিনি। ঝাড়ুর ধূলোয় চারপাশ অন্ধকার, উদীয়মান সূর্য্যকিরণও ঢেকে দেয়ার জোগাড়। একেবারেই দমবন্ধ হবার উপক্রম।

পরিবারের পাঁচ জনের শোবারঘর, রান্নাঘর মিলে ছয়টি ঝুপড়িঘর তার। সমস্ত ঘরদোর ঝাড়ু দিয়ে এক বালতি আবর্জনা গুছিয়েছেন তিনি। তাতে পঁচাগলা তরকারি, চিপ্সের প্যাকেট, কিছু ক্লিনিক্যাল বর্জের সাথে আছে একটা মরা ঈঁদুরও। শহরের মত আবর্জনা সংরক্ষণের নির্দিষ্ট জায়গা নেই এখানে। ফলে বলতি ভর্তি বর্জ্য নিয়ে গিয়ে উঠান ঘেঁসা নিস্কাষন নালায় ফেলে দিলেন এই গৃহিনী।

কুতুপালং’এর মধুছরার উঁচু-নিচু পাহাড়ের প্রতিটি ঘরেই ঘটছে একই ঘটনা। ক্যাম্পের টং’এর দোকানে বসে ছিলেন মোহাম্মদ ইসমাইল। কমিউনিটি রেডিও নাফের অনুষ্ঠান পালং এর হতার সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানাচ্ছিলেন, দোকান থেকে খাবারের সাথে থাকা পলেথিন, সব্জি বাজারের আবর্জনা বা ত্রাণ যে কাগজে দিয়েছে সেটাও আমরা যেখানে সেখানে ফেলে দিই।

কি ছেলে কি বুড়ো ক্যাম্পের বাসিন্দাদের কেউই সচেতন নন পরিবেশ সুরক্ষায়। যারা পাহাড়ের উঁচুতে থাকেন তাদের ফেলে দেয়া আবর্জনা ঢাল বেয়ে নেমে আসছে নিচের দিকে। এ ভাবেই নোংরা হচ্ছে চারপাশ।

কুতুপালং ক্যাম্পের পাহাড়ের টিলাগুলো ঘেঁষে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে খাল। ক্যাম্পের পয়:নালা হয়ে উঠেছে এটি। হাট-বাজারের দূষিত পানি গিয়ে পড়ছে নালায়। এই নালায় উন্মক্ত প্রত্যেকটি বাড়ির শৌচাগারের পাইপলাইন। খালে পড়ছে গৃহস্থালির বর্জ্যরে সাথে ব্যবহার নিষিদ্ধ পলিথিন। এতে বন্ধ হচ্ছে খালের স্বাভাবিক প্রবাহ। উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে চারপাশে।

এক কথায় রোগের আঁতুরঘর হয়ে উঠেছে পুরো খাল। অথচ দূষিত খালের পানিতেই দাপাদাপি করছে ক্যাম্পের শিশুরা। এদিকে নজর নেই অভিভাবকদের। ফলে বাড়ছে রোগের সংক্রমন, ব্যহত হচ্ছে শিশু সুরক্ষা। যে কোন মুহূর্তে বায়ু ও পানি বাহিত রোগের মারাত্মক সংক্রমন ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে পালং এর হতার পয়তালি­শ তম পর্বে কক্সবাজার জেলার ডিজি হেলথ সার্ভিসেসের চিকিৎসক ডাঃ মাহাবুব আল সাহেদের সাথে কথা হয়। তিনি জানাচ্ছিলেন, চলাফেরা এমনকি টয়লেটে যাবার সময় স্যান্ডেল ব্যবহারে অভ্যস্ত নন উখিয়া ক্যাম্পের বাসিন্দারা। পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতায় উদাসিন তারা। ক্যাম্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। এতে বাচ্চারা সহজেই পেটের পীড়া ও কৃমিতে আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়া চুলকানি ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হবার প্রবনতা বাড়তে পারে।

বর্ষার সময় এ ক্যাম্পে পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে এমন শঙ্কা ডাঃ মাহবুব আল সাহেদের। তিনি বলছেন, এতে ডায়রিয়া, কলেরা ছড়িয়ে পড়তে পারে। তা ছড়িয়েও পড়তে পারে মহামারি আকারে। তাছাড়া বর্জ্য মিশ্রিত পানি জমে ছড়িয়ে পড়তে পারে ডেঙ্গু।
পরিস্থিতি উত্তরনে এখানকার অধিবাসীদের স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তুলতে সহযোগিতা করছে কর্মরত বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাগুলো।

উখিয়ার পাহাড়ি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাস করছেন প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা। প্রতি দিনই শত শত টন গৃহস্থালি বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে এখানে। কিন্তু বর্জ্য ব্যস্থাপনার সুযোগ না থাকায় তাতে ছড়াচ্ছে মারাত্মক দূষণ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিপুল এই জনগোষ্টির একটি বড় অংশ পরিবেশ সুরক্ষায় সচেতন নন। এই বর্জ্য কেবলই তাদের কাছে ফেলনা। বর্জ্য সরাতে সেকেলে ধ্যান ধারণা নিয়েই বাস করছেন রোহিঙ্গারা।

বর্জ্য সংরক্ষনে বাড়ির পাশের গর্তটিই ভারসা ক্যাম্প বাসিন্দাদের। প্রতিদিনের গৃহস্থালি বর্জ্য নানান সময় এই গর্তে নিয়ে গিয়ে ফেলছেন তারা। কখনো কখনো লোকজনের চলাচল নেই এমন স্থান বেছে নিচ্ছেন ময়লা ফেলতে। এমন অসংখ্য গর্ত আর ময়লার স্তুপ তৈরী হয়েছে পুরো রোহিঙ্গা ক্যাম্পজুড়েই।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নানান ইস্যু নিয়ে কাজ করছে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন। সংস্থাটি ক্যাম্পের অধিবাসীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করছে। এর সুফলও পাচ্ছেন অধিবাসীরা।

ওয়ার্ল্ড ভিশনের কর্মকর্তা এবং জামতলী ক্যাম্প পনেরর ওয়াশ ফোকাল ইলিয়াস মুরমু জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রতিটি ব্লকেই তারা নানান ইস্যু নিয়ে কাজ করছেন। এর মধ্যে ১৩, ১৫, ১৮ ও ৮-ই এবং ৮-ডাব্লিউ ক্যাম্পের বাসিন্দাদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে ডাস্টবিন। এখানকার বাকি ক্যাম্প গুলোতেও পর্যায়ক্রমে ডাস্টবিন পৌঁছে দেয়ার কথা জানান।

তিনি আরো বলেন, প্রতি ৫টি পরিবারের ছোট ছোট গ্রুপে ডাস্টবিন বিতরণ করা হয়েছে। পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য আলাদা সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে বাসিন্দাদের। পুরো প্রক্রিয়া যথাযথভাবে বাস্তবায়নে প্রতি দশটি পরিবারের জন্য একটি করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি পরিবারগুলোর পরিচ্ছন্নতায় নজরদারি চালাচ্ছে। সংরক্ষিত বর্জ্য নিজস্ব দু দিন পরপর নিজেদের ডাম্পিং পয়েন্টে নিয়ে গিয়ে ফেলছে ওর্য়াল্ড ভিশান।

পচনশীল বর্জ্য থেকে কম্পোস্ট এবং অপচনশীল বর্জ্য পুন: ব্যবহারযোগ্য করে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে ক্যাম্পের বাসিন্দাদের মাঝে। কিছু বিক্রি হচ্ছে ভাঙড়ির দোকানেও। স্বাস্থ্যকর অভ্যাসের দরুণ ক্যাম্পের বাসিন্দাদের যত্রতত্র ময়লা ফেলার প্রবণতা কমে আসছে। প্রশিক্ষণসহ নানান সহায়তা নিয়ে তারা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানান ওয়ার্ল্ড ভিশনের ইলিয়াস মুরমু।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে জনসচেতনতামূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে পরিচ্ছন্নতায় কাজ করছে আরেক বেসরকারী সংস্থা ক্রিষ্টিয়ান কমিশন ডেভলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ-সিসিডিবি। সংস্থাটির প্রোগ্রাম ম্যানেজার আব্দুল্লাহ্ আল মামুন জানান, পরিবেশ সুরক্ষায় ক্যাম্পের ৪ হাজার ৮০০ পরিবারকে ডাস্টবিন সেবার আওয়াতায় এনেছে সিসিডিবি। তাছাড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে কি দুর্যোগ নেমে আসতে পারে সে বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে বাসিন্দাদের। উঠান বৈঠকসহ নানান কৌশলে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সংস্থাটি।

আব্দুল্লাহ্ আল মামুন জানান, এরই মধ্যে ক্যাম্পের কোথাও কোথাও বাসিন্দা স্বাস্থ্যকর ডাস্টবিন ব্যবহারে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছেন। সূত্র: পালং এর হতা, রেডিও নাফ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়