শিরোনাম
◈ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী ◈ দাম বেড়েছে আলু, ডিম, আদা ও রসুনের, কমেছে মুরগির  ◈ ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৮টি কূপ খনন শেষ করতে চায় পেট্রোবাংলা ◈ ভিত্তিহীন মামলায় বিরোধী নেতাকর্মীদের নাজেহাল করা হচ্ছে: মির্জা ফখরুল ◈ বিনা কারণে কারাগার এখন বিএনপির নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী ◈ অপরাধের কারণেই বিএনপি নেতা-কর্মীদের  বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী  ◈ অ্যাননটেক্সকে জনতা ব্যাংকের সুদ মওকুফ সুবিধা বাতিলের নির্দেশ বাংলাদেশ ব্যাংকের ◈ চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি, হিট এলার্ট জারি  ◈ ঢাকা শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে ◈ ইরানে ইসরায়েলের হামলার খবরে বিশ্বজুড়ে উত্তেজনা, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্ক

প্রকাশিত : ১০ মে, ২০১৯, ১২:০৩ দুপুর
আপডেট : ১০ মে, ২০১৯, ১২:০৩ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম বিচার দাবি

এম নজরুল ইসলাম : ১৯৭৫ সালে সপরিবারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাÐের পর জাতি ছিল স্তম্ভিত, দিকনির্দেশনাহীন। জাতির জনক নিহত। দলের অনেকেই ঘাতকদের সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতার ভাগাভাগিতে ব্যস্ত। সামরিকতন্ত্রের বুটে পিষ্ট গণতন্ত্র। বাকস্বাধীনতা ছিল না দেশে। দেশের বাইরে কেউ এ হত্যাকাÐ নিয়ে প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে পারেননি। বাঙালিদের কাছে জাতির জনকের নৃশংস হত্যাকাÐ এমন এক অবিশ্বাস্য ও নারকীয় ঘটনা ছিল, শোকে মুহ্যমান জাতি একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ে। এর বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করার মতো শক্তি সেই মুহূর্তে ছিল না। বস্তুত বঙ্গবন্ধুকে হঠাৎ করে হারিয়ে গোটা জাতি এমন শোকাহত ও বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল, কোনোরূপে প্রতিক্রিয়া প্রকাশের শক্তিও তাদের ছিল না। কিন্ত থেমে ছিলেন না জাতির জনকের দুই কন্যা। তারা বিশ্বমানবতার কাছে পিতৃহত্যার বিচার চেয়েছিলেন। বিচার চেয়েছিলেন ইতিহাসের এ নৃশংস হত্যাকাÐের। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাÐের বিচার চেয়ে বিশ্বমানবতার কাছে প্রথম আবেদন রাখা হয় ১৯৭৯ সালের ১০ মে। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে বিশ্বমানবতার কাছে এ আর্জি পেশ করেছিলেন বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠা কন্যা শেখ রেহানা।

১০ মে ১৯৭৯। সেদিন স্টকহোমে অনুষ্ঠিত হয় সর্বইউরোপীয় বাকশালের এক সম্মেলন। ওই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদানের জন্য অনুরোধ জানান হয়েছিল। কিন্তু তখন ভারত থেকে সুদূর সুইডেনে গিয়ে সম্মেলনে যোগ দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সর্বইউরোপীয় নেতারা শেখ হাসিনার প্রতিনিধিত্ব করতে শেখ রেহানাকে অনুরোধ করেন। দিল্লি থেকে ফোনে শেখ হাসিনাও বোনকে বলেন সম্মেলনে যেতে। অনুষ্ঠানে কী বলতে হবে সে বিষয়ে তিনি টেলিফোনে ছোট বোনকে নির্দেশনা দেন। শেখ রেহানা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।

সম্মেলনের প্রধান অতিথি শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তার পাঠানো বাণী পাঠ করেন শেখ রেহানা। তার পক্ষে বক্তব্য রাখেন তিনি। এটাই ছিল কোনো রাজনৈতিক সমাবেশে শেখ রেহানার প্রথম বক্তব্য। আন্তর্জাতিক এ সম্মেলনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে তিনিই সর্বপ্রথম পঁচাত্তরের কলঙ্কজনক ও অমানবিক হত্যাকাÐের বিচারের দাবি তোলেন। সে দিন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, জাতিসংঘের মহাসচিব, জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কমিশনের চেয়ারম্যান, আমেরিকার কংগ্রেসের হিউম্যান রাইটস কমিটির চেয়ারম্যান, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের প্রধানদের কাছে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যার বিচারের প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি। পঁচাত্তরের পৈশাচিক বর্ণনা দিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে শেখ রেহানার আবেগঘন বক্তব্য সে অনুষ্ঠানে এক হƒদয়বিদারক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। হলভর্তি প্রবাসী বাঙালি নারী-পুরুষ এবং বিদেশি রাজনীতিবিদ, পার্লামেন্ট সদস্য ও সাংবাদিক পিনপতন নীরবতায় তার বক্তব্য শোনেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত অনেকের কাছ থেকে জানা যায়, তার বক্তব্য উপস্থাপনায় অনেকের চোখই অশ্রæসজল হয়ে ওঠে।
১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ট্র্যাজেডির বিচার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা সবসময় ভাবতেন। ১৯৭৯ সালের জুন মাসে এক দিন শেখ রেহানা চিন্তা করেন, ‘প্রখ্যাত আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসি এম পি তো তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বিশিষ্ট কৌঁসুলি ছিলেন। তাকে দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার মামলা করা যায়।’ এ ব্যাপারে তিনি টেলিফোনে দিল্লিতে বড় বোনের সঙ্গে পরামর্শ করেন। শেখ হাসিনার পরামর্শ অনুযায়ী ১৯৮০ সালের ২০ জানুয়ারি সেন্ট্রাল লন্ডনের কনওয়ে হলে সর্বইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ড. সেলিমকে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করা হয়। ড. শফিক সিদ্দিক সভাপতি পদে প্রস্তাব করেন স্যার টমাস উইলিয়ামসের নাম। যা সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুকন্যাদের সম্মতিতেই ড. শফিক সিদ্দিক আন্তর্জাতিক খ্যতিসম্পন্ন এ ব্রিটিশ আইনজীবীর নাম প্রস্তাব করেছিলেন।
স্যার টমাস উইলিয়ামসের সম্মতি নেওয়ার জন্য ১৯৮০ সালের ফেব্রæয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে ‘হাউস অব কমন্সে’ গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন শেখ রেহানা ও তার স্বামী ড. শফিক। তাকে জানান, বিদেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রচার করার লক্ষ্যে সম্প্রতি সর্বইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠিত হয়েছে। এতে সভাপতি পদের জন্য তাকে মনোনীত করা হয়েছে। প্রস্তাব শুনে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন স্যার টমাস উইলিয়ামস। তিনি তাদের জানান, ‘সেই কতকাল আগে ১৯৬৮ সালে আমি ঢাকা গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করতে। তারপর এলো ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। তখনও আমি তোমাদের সঙ্গে ছিলাম। সে তো প্রায় ১০ বছর আগের কথা। তোমরা বাঙালিরা এখনও আমাকে মনে রেখেছ! আমি নিজে বঙ্গবন্ধুর একজন অনুরাগী এবং ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি হওয়ার প্রস্তাব আমি সানন্দে গ্রহণ করলাম।’ শেখ রেহানা তাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান।

১৯৮০ সালের ৪ এপ্রিল শেখ হাসিনা তার ছেলে ও মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লি থকে লন্ডন যান। শেখ রেহানা তখন সন্তানসম্ভাবনা। ১৯৮০ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে এক দিন স্যার টমাস উইলিয়ামস শেখ হাসিনাকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আমন্ত্রণ জানান। শেখ হাসিনা তার আমন্ত্রণ রক্ষা করেন। স্যার টমাস উইলিয়ামস ওইদিন তাকে পার্লামেন্ট বিল্ডিং ঘুরিয়ে দেখান। ওই সময় শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্ত কমিশন গঠন করার দায়িত্ব নিতে তাকে অনুরোধ করেন। এতে তিনি সম্মত হন। কিছু দিন পর আবার স্যার টমাস উইলিয়ামসের সঙ্গে শেখ হাসিনা বৈঠক করেন। সেদিন সিদ্ধান্ত হয়, বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকী পালন অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকবেন।
শেখ হাসিনাকে গণসংবর্ধনা জ্ঞাপন এবং বঙ্গবন্ধুর পঞ্চম শাহাদতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে ১৬ আগস্ট (১৯৮০) পূর্ব লন্ডনের মাইল্যান্ডের ইয়র্ক হলে যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাঙালিদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তি সংগ্রামের পর প্রবাসী বাঙালিদের এর চেয়ে বড় সমাবেশ আর অনুষ্ঠিত হয়নি। সমাবেশে শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি এবং স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসি এমপি প্রধান বক্তা ছিলেন। তা ছাড়া ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টির পক্ষ থেকে ড. কর্নরার্ড উড এবং লেবার পার্টির দুজন পার্লামেন্ট সদস্য বক্তব্য রাখেন। সেদিন বেশ কজন ব্রিটিশ রাজনীতিক ও প্রখ্যাত আইনজীবী এবং বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাঙালির উপস্থিতিতে শেখ হাসিনার অনুরোধে স্যার টমাস উইলিয়ামস বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যাকারীদের আদালতের কাঠগড়ায় হাজির করার ব্যাপারে উপযুক্ত কর্মপন্থা গ্রহণ করবেন বলে শেখ হাসিনাকে প্রতিশ্রæতি দেন।
বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যা সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য বিশ্বখ্যাত আইনজ্ঞদের নিয়ে ১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর লন্ডনে একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৮০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর লন্ডনের ‘হাউস অব কমন্স’-এর নিকটবর্তী কুন্দুন রেস্টুরেন্টে এক সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসি এমপি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাÐের তদন্ত কমিশন গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। কমিশনের চেয়ারম্যান হন, স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসি এমপি, সদস্যরা হলেন, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী বিখ্যাত আইরিশ আইনজীবী মি সন ম্যাকব্রাইড, লেবার পার্টির আইন বিষয়ক মুখপাত্র জেফ্রি টমাস কিউসি এমপি এবং সলিসিটার মি. অব্রে রোজ। মি. অব্রে রোজকে কমিশনের সেক্রেটারির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই সাংবাদিক সম্মেলনে তদন্ত কমিশনের সদস্যরা ছাড়াও কনজারভেটিভ পার্টির আইন বিষয়ক মুখপাত্র ও এমপি, লিবারেল পার্টির আইন বিষয়ক মুখপাত্র ও এমপিসহ বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা এবং ড. কামাল হোসেনসহ বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাঙালি উপস্থিত ছিলেন। ১৯৭৫ সালের হত্যাকাÐের বিচারের পক্ষে বিশ্ববিবেক জাগ্রত করতে এ তদন্ত কমিশন গঠন ছিল শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নিরন্তর প্রচেষ্টার ফসল।

১৯৮১ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশনের সদস্য জেফ্রি টমাস কিউসি এমপি এবং সলিসিটার মি অব্রে রোজ বাংলাদেশ সফরের জন্য লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ভিসার জন্য আবেদন পেশ করেন। ১৩ জানুয়ারি, ১৯৮১ সন্ধ্যাবেলা কমিশনের সদস্যরা ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিমানযোগে ঢাকা যাওয়ার জন্য অবিলম্বে ভিসা পাওয়া প্রয়োজন বলে সেদিন সকাল বেলা প্রেরিত এক জরুরি বার্তার জবাবে বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে বলা হয়, ভিসাসহ পাসপোর্টগুলো বিকাল বেলা ফেরত দেওয়া হবে। বিকালে হাইকমিশনে গিয়ে পাসপোর্টগুলো ফেরত পাওয়া সম্পর্কে খোঁজ করা হলে বলা হয়, কন্সুলার বিভাগ বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরও বেশ কিছু দিন তারা ভিসা পাওয়ার লক্ষ্যে লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনের তৎকালীন হাইকমিশনার আমিনুর রহমান সামছউদ দোহার (এ আর এস দোহা নামে পরিচিত) সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। এমনকি তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়ার নির্দেশে এ আর এস দোহা (জিয়ার ঘনিষ্ঠবন্ধু) অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে ভিসা নামঞ্জুর সম্বন্ধে কোনো চিঠি কিংবা কোনো রকমের ব্যাখ্যা দেননি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাদের হত্যাকাÐে জেনারেল জিয়া জড়িত থাকা সম্পর্কে তথ্য চাপা দেওয়া সম্ভব হবে না বলেই তদন্ত কমিশনের সদস্যদের ভিসা মঞ্জুর করা হয়নি এবং তাদের বাংলাদেশে যেতে দেওয়া হয়নি।
১৯৮১ সালের ২৮ জানুয়ারি লর্ড ফেনার ব্রকওয়ে তদন্ত কমিশনের সদস্যদের বাংলাদেশের ভিসা নামঞ্জুর করার বিষয়টি হাউস অব লর্ডসে উপস্থাপন করেন। যা ৪ ফেব্রæয়ারি হাউস অব লর্ডসে আলোচিত হয়। ওই আলোচনায় তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড ক্যারিংটনসহ অনেকে অংশ নেন। আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশনের সদস্যদের বাংলাদেশ সফরের জন্য ভিসা নামঞ্জুরের প্রতিবাদে ১৯৮১ সালের ১৩ জানুয়ারি ঢাকায় ব্যাপক প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। তদন্ত কমিশনের সদস্যদের বাংলাদেশে আসার অনুমতি আদায়ের দাবিতে ১৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের উদ্যোগে দেশব্যাপী জনসমাবেশ ও প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮২ সালের ২০ মার্চ আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গ এবং চার জাতীয় নেতার হত্যা সম্পর্কে প্রাথমিক রিপোর্ট পেশ করেন।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি’ অধ্যাদেশ জারি করেন খোন্দকার মোশতাক। যা জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখলের পর ১৯৭৯ সালের এপ্রিল মাসে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৭৬ সালের ৮ জুন ফ্যাসিস্ট জেনারেল জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকাÐের ১২ জন আত্মস্বীকৃত খুনিকে বিদেশে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত ও পুনর্বাসিত করেন।

তখন দেশে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ প্রায় নিষিদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার স্বদেশ ফিরে আসার পথে সামরিক জান্ত জেনারেল জিয়া তৈরি করেন নিষেধের বেড়াজাল। ওই সময় অতল অন্ধকারের ঘূর্ণাবর্তে ঘুরপাকরত দিকনির্দেশহীন, কাÐারিবিহীন জাতিকে নেতৃত্বের শূন্যতা থেকে রক্ষা করার জন্য বঙ্গবন্ধুপ্রেমী কোটি কোটি মানুষের দৃষ্টিতে একমাত্র আশার প্রদীপ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সেই লক্ষ্যেই ১৯৮১ সালের ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রæয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তার অনুপস্থিতে তাকে সর্বসম্মতিক্রমে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। দেশমাতৃকার প্রতি কর্তব্যবোধে অনুপ্রাণিত শেখ হাসিনা স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়ার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ওই বছরেরই ১৭ মে দীর্ঘ প্রায় ৬ বছরের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে স্বদেশভ‚মিতে ফিরে আসেন। ঢাকায় সেদিন লাখো জনতা বৈরী আবহাওয়াকে উপেক্ষা করে জাতির জনকের উত্তরসূরিকে একনজর দেখা ও প্রাণঢালা সবংর্ধনা জানানোর জন্য নানা প্রতিবন্ধকতা ছিন্ন করে সমবেত হয়েছিল। বিপুল প্রতিক‚লতা মোকাবেলা করে দেশ ও মানুষের কল্যাণে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেন। একাধিকবার অলৌকিকভাবে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসে তিনি জনতার কল্যাণযুদ্ধে ব্যাপৃত হয়েছেন। নিজের জীবনকে বাবার মতোই তুচ্ছ জ্ঞান করে মুক্তিপাগল বাঙালির নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেসব ইতিহাস সবার জানা।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত অবাধ, নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর আবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসীন করেন শেখ হাসিনা। তখন ‘ইনডেমনিটি’ অধ্যাদেশ বাতিল করার জন্য তঁর সরকার আদালতের শরণাপন্ন হয়। আদালত অধ্যাদেশটি সংবিধানের পরিপন্থি বলে রায় দেন। তারপর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি’ অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়।

অতপর ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে হত্যাকারীদের বিচার অনুষ্ঠান না করে দেশের প্রচলিত আইনে স্বাভাবিক পন্থায় বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৯৭ সালের ১২ মার্চ বিচারকার্য শুরু হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর বিচারক কাজী গোলাম রসূল মামলার রায় ঘোষণা করেন। ১৫ জনের মৃত্যুদÐ হয়। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলে হাইকোট ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল ১২ আসামির মৃত্যুদÐাদেশ বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেয়। তারপর মৃত্যুদÐপ্রাপ্ত চার আসামি লিভ টু আপিল করে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতা কুক্ষিগত করে বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে। নানা ছল-ছাতুরির মাধ্যমে ৫ বছর এবং তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আমলে প্রায় দুই বছর কাল দÐপ্রাপ্ত আসামিদের পক্ষে করা আপিলের শুনানি শুরু করা সম্ভব হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হয়ে শেখ হাসিনা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পর ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর ওই আপিলের তথা মামলার চ‚ড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয়। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। সেদিন দেশে-বিদেশে বাঙালিরা দারুণভাবে উল্লসিত হয়েছে। কোটি কোটি মানুষ নফল নামাজ পড়েছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে শোকরানা আদায় করেছে। বলেছে, দীর্ঘ ৩৪ বছর পর জাতি কলঙ্ক ও অভিশাপমুক্ত হয়েছে। দÐপ্রাপ্ত পলাতকদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে ফাঁসির রায় কার্যকর করার চেষ্টা চলছে। আজ সেই দিন, ১৯৭৯ সালের এদিনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চেয়ে আবেদন জানানো হয়েছিল বিশ্ববিবেক ও বিশ্বমানবতার কাছে। আজ দেশ ও জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। এ কলঙ্কমোচনের প্রথম সোপান রচিত হয়েছিল আজকের এই দিনে সুদূর সুইডেনে। আর এই সোপান রচনায় অগ্রণী ভ‚মিকা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোটবোন শেখ রেহানা।

সর্বইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়