শিরোনাম
◈ দক্ষিণ ভারতে ইন্ডিয়া জোটের কাছে গো-হারা হারবে বিজেপি: রেভান্ত রেড্ডি ◈ ইরানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নতুন নিষেধাজ্ঞা ◈ আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম  ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ◈ মিয়ানমার সেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না: সেনা প্রধান ◈ উপজেলা নির্বাচন: মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আওয়ামী লীগের ◈ বোতলজাত সয়াবিনের দাম লিটারে ৪ টাকা বাড়লো ◈ রেকর্ড বন্যায় প্লাবিত দুবাই, ওমানে ১৮ জনের প্রাণহানি

প্রকাশিত : ৩০ মার্চ, ২০১৯, ০৫:১৪ সকাল
আপডেট : ৩০ মার্চ, ২০১৯, ০৫:১৪ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

সামা‌জিক বাধা ডি‌ঙ্গি‌য়ে আত্মপ্রত্যয়ী সংগ্রামী ৬কি‌শোরী সু‌যোগ পে‌লেন জাতীয় ম‌হিলা ফুটবল দ‌লে

মো.সাদ্দাম হো‌সেন, ঠাকুরগাঁও : প্রত্যন্ত এলাকায় নি‌জে‌কে ছা‌ড়ি‌য়ে নেয়ার স্বপ্ন দেখাটা সম্ভবত একটু বে‌শি বাড়াবা‌ড়ি। ত‌বে অসম্ভব তো কিছুই নেই। সম্ভবনা আর প্রবল ইচ্ছেশ‌ক্তি থাক‌লে নি‌জে‌কে ছা‌ড়ি‌য়ে নেয়া যায় সেরা‌দের তা‌লিকায়।

তাদের সামনে কেবল সামাজিক বাঁধাই ছিল না , ছিল দারিদ্র, বাল্যবিবাহের চোখ রাঙ্গানী , ছিল ফুটবলাার হবার জন্য পর্যাপ্ত সরঞ্জামের অভাব। সব প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার নিভৃতপল্লীর সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত গ্রামের মেয়েরা ফুটবল খেলছে, দেশের পরিসর অতিক্রম করে কেউ কেউ লাল সবুজ জার্সিতে আন্তর্জাতিক সীমানায় পা রাখছে , অর্জন করছে ফুটবলার হিসেবে পেশাদারিত্ব যা ছিল স্বপ্নেরও অতীত। এমনিতেই যেখানে তাঁরা ফুটবল খেলছে সেসব প্রত্যন্ত গ্রামের চোখগুলো নারীদের হাফপ্যান্ট আর জার্সিতে ফুটবল খেলা দেখতে মোটেই অভ্যস্ত ছিলো না। আজ সেই চোখগুলোতে ঝড়ছে প্রমিলা খেলোয়ারদের জয়ে উচ্ছ্বাসের ঢেউ , তাদের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তিত হয়ে ফুটবল বীরঙ্গনাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজেদের মেয়েদের উৎসাহিত করছেন মাঠে যেতে।

ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েদের জাতীয় পর্যায়ের ফুটবলার হয়ে উঠবার এই ব্যতিক্রমী সাহসী উদ্যোগের পুরোভাগে ছিলেন এলাকার ক্রীড়া অনুরাগী অধ্যক্ষ তাজুল ইসলাম। এই ক্যারিসমাটিক সংগঠক দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েদের নিয়ে জেলা শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে অজপাড়াগাঁয়ে ব্যক্তি মালিকানায় গড়ে তুলেছেন রাঙ্গাটুঙ্গি মহিলা ফুটবল একাডেমি নামে একটি মহিলা ক্রীড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

এই মেয়েরা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে জেলায় কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেই টিম রংপুর বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, জাতীয় পর্যায়ে গিয়েও দুইবার রানার্সআপ হয়েছে। কয়েকজন বিএকেএসপিতে সুযোগ পেলেও অর্থের অভাবে ভর্তি হতে পারেননি বলে জানা গেছে।

ফুটবল ফেডারেশন থেকে ২ জন খেলোয়াড় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে ১০ লাখ টাকা করে আর্থিক অনুদান পেয়েছেন। সেই টাকায় তাদের দরিদ্র পরিবার ঘরবাড়ি নির্মাণসহ জমি কিনে ফসল ফলাচ্ছেন। তাদের দেখে এলাকায় মহিলা খেলোয়াড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও অর্থের অভাবে কার্যক্রম চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন মহিলা ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক।

ইতোমধ্যে রাঙ্গাটুঙ্গি মহিলা ফুটবল একাডেমির ৬ জন নারী ফুটবলারের ঠাই হয়েছে জাতীয় মহিলা দলে। এদের মধ্যে অনুর্ধ ১৬ দলে সোহাগী কিসকু ও মুন্নী আক্তার আদূরী বর্তমানে মায়ানমারে বাংলাদেশের হয়ে খেলছেন। আর অনুর্ধ ১৫ দলে বিথীকা কিসকু, কোহাতী কিসকু, কাকলী আক্তার, শাবনুর নিয়মিত অনুশীলন করছেন।

শুরুর কথা রূপকথার মতোই মনে হতে পারে। ২০১৪ সালে রাণীশংকৈল রাঙ্গাটুঙ্গি এলাকার মাঠে একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। খেলার বেশির ভাগ দর্শক ছিলেন নারী। মাঠের পাশেই কয়েকজন মেয়ে ফুটবল নিয়ে খেলছিলো।

তখন তাদের ডেকে এলাকার ক্রীড়া অনুরাগী অধ্যক্ষ তাজুল ইসলাম ফুটবল খেলার কথা বলেন। তাদের ফুটবল খেলার আগ্রহ দেখে পরের দিন মাঠে অনুশীলনের জন্য আসতে বলেন। প্রথম দিনে ৫ জন, এভাবে বর্তমানে আরও ২৪ জন ক্ষুদে ফুটবলার নিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

২০১৪ সালের পর থেকে রাঙ্গাটুঙ্গি মহিলা ফুটবল একাডেমিকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাকি মেয়েদেরও স্বপ্ন জায়গা করে নিতে হবে জাতীয় দলে। সেই সঙ্গে ঠাকুরগাঁওয়ের নাম ছড়িয়ে দিবে বিশ্বব্যাপী। সেই লক্ষ্যে ক্ষুদে এই খেলোয়াড়রা কোচ জয়নুল ইসলাম, শুগা মরমু ও পরিচালক অধ্যক্ষ তাজুল ইসলামের অধীনে অনুশীলন করছেন প্রতিদিন।

আজ বিভিন্ন গ্রাম থেকেও খেলতে আসছে মেয়েরা। জেলা থেকে বিভাগীয় পর্যায়ে, সেখান থেকে জাতীয় পর্যায়ে খেলছেন তারা।

মেয়ে ফুটবলাররা জানান, “যখন মহিলা ফুটবল শুরু হয়, তখন গ্রামের মানুষের অনেক আপত্তি ছিলো, কেন মেয়েরা হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেলবে? এমনও হয়েছে মাঠে খেলা শুরুর পরও আমাদের উঠে আসতে হয়েছে। সেই অবস্থা থেকে উঠে এসে এখন আমাদের বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জের মেয়েরা ফুটবল খেলছে। সত্যিই এখন অনেক ভালো লাগে।” কিন্তু তাজুল স্যারের প্রচেষ্টায় অনেকটা এগিয়ে গেলেও অর্থের কারণে অনেক সময় নিয়মিত অনুশীলন করতে পারছি না। খেলতে গেলে খাওয়ার প্রয়োজন, নিয়মিত অনুশীলনের জন্য যদি সরকারিভাবে খাবার, খেলাধুলার সরঞ্জাম ও একজন ভাল প্রশিক্ষক হতো, তাহলে এখান থেকে অনেক ভাল খেলোয়াড় আছে, যারা জাতীয় দলে খেলার যোগ্যতা রাখে ও খেলতে পারতো।

ক্রীড়া অনুরাগী অধ্যক্ষ তাজুল ইসলাম জানান, অনেক কষ্ট করে গ্রামের মেয়েদের ভাল ফুটবলার তৈরিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। নিজ উদ্যোগে একটি একাডেমি তৈরি করেছি। সরকারি বা কোন অর্থশালী ব্যক্তি যদি এগিয়ে আসেন, তাহলে এখান থেকে দেশের ভাল মানের নারী ফুটবলার তৈরি হবে। তারা এলাকার ও দেশের সুনাম বয়ে নিয়ে আসার ক্ষমতা রাখে।

তিনি আরও বলেন, রাঙ্গাটুঙ্গি মহিলা ফুটবল একাডেমির ৬ জন খেলোয়াড় জাতীয় দলে খেলছে। ২ জন ১০ লাখ করে অনুদান পেয়েছে তাদের পরিবার লাভবান হয়েছে। আশা করি বাকিরাও পাবে।

তবে বাফুফের উচিত, লোকালয়ে যে সকল খেলোয়াড় তৈরীর প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে, তাদের প্রতি সহযোগীতার হাত বাড়ানো।

কারণ, প্রতিষ্ঠান না থাকলে জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়াড় তৈরি হবে না। খেলোয়াড়দের পাশাপাশি খেলার প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতা না করলে এক সময় মহিলা ফুটবল পুরুষ ফুটবলের মতো হতে পারে। নিজের অর্থ ব্যয় করে রাঙ্গাটুঙ্গি মহিলা ফুটবল একাডেমিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু অর্থের অভাবে ইচ্ছে থাকলেও সবার চাহিদা পূরণ করতে পারছি না।

কয়েক জনকে বিকেএসপিতে ভর্তি নিতে চাচ্ছে কিন্তু অর্থের অভাবে তাদের ভর্তি করতে পারছি না। প্রথমে সরকারি ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে কিছু সহযোগিতা পেলেও এখন আর পাই না।
আদুরি ও সোহাগী বাফুফে’র ক্যাম্প থেকে ছুটি পেয়ে বাড়ি এসেছিলেন, তাদেরকে ধরা হলো তাদের বাড়িতে গিয়ে। সোহাগী’র বাবা দিনমজুর, অন্যের জায়গায় মাটির ঘর করে তাদের বসবাস। বড় বোন শুরু করেছিলেন তাজুল স্যারের টিমে খেলা, আবেগে ভেসে বোনটি পালিয়ে বিয়ে করে, বছর ঘুড়তে মা হয়। একজন সম্ভাবনাময় ফুটবলারের এভাবে ঝড়ে পড়ায় চোখে জল আসে তাজুল স্যারের। তবে আদুরী সে আশা পূরণ করে, সে জানালো কিছুতেই বাল্য বিবাহের ফাঁদে সে পা দেবে না। সোহাগীর বাবাও দিনমজুর , তার দু’টি মেয়ে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছে। আরেক জন তারকা কাকলীর মা চা বিক্রেতা আর বাবা ভ্যান চালক। এদের সবার চোখে জীবন জয়ের দুর্বার প্রতিজ্ঞা, অনুশীলন চলাকালে ওদের সাক্ষাৎকার নিতে চাইলে তারা বেজায় বিরক্ত, কারণ তাদের রক্তে ফুটবলের নেশা, অন্য কোনো প্রলোভন তাদের টানে না।

জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান বাবু বলেন, রাঙ্গাটুঙ্গি মহিলা ফুটবল একাডেমির মেয়েরা আমাদের গর্ব। সেই একাডেমি থেকে ৬ জন জাতীয় দলে খেলছে আশা করি ভবিষ্যতে আরও অনেকে খেলবে। আগে সাধ্য অনুযায়ি সহযোগিতা করা হয়েছে আগামীতেও ব্যবস্থা করা হবে।

জেলা প্রশাসক ড. কামরুজ্জামান সেলিম বলেন, এসব ফুটবলারদের বিকাশ , প্রশিক্ষণ ও এগিয়ে চলার পথ যেন সুগম হয় সে ব্যাপারে সরকার থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে আরো উদ্যোগ নেয়া হবে। জেলা সরকাররি উদ্যোগে উচ্চতর ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যাতে গড়ে ওঠে সে ব্যাপারটিতেও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়