শিরোনাম
◈ ভুটানের রাজার সঙ্গে থিম্পু পৌঁছেছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ চট্টগ্রামের জুতার কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে ◈ জিয়াও কখনো স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেনি, বিএনপি নেতারা যেভাবে করছে: ড. হাছান মাহমুদ ◈ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য: গয়েশ্বর ◈ সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে দেশ চালাচ্ছে সরকার: রিজভী ◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

প্রকাশিত : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ০৩:৫৮ রাত
আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ০৩:৫৮ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

কবি অসীম সাহা, তারুণ্য ও প্রেমিক কবির প্রতিকৃতি

ফরিদ আহমদ দুলাল : বাংলা কবিতার ইতিহাসে ষাটের দশক নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ষাটের দশকে যাদের কবিতায় পদার্পণ তাদের অনেকেরই প্রতিষ্ঠা সত্তরের দশকে হলেও ষাটের দশকের কাব্য-আলোচনায় ষাটে আবির্ভূত কবিরাই আলোচিত হবেন। ষাটের কবিতা এবং কবিদের প্রধান প্রবণতা লিটল ম্যাগাজিন। নির্ভরতা তাদের অনেক বেশি সাহসী ও পরিশ্রমী করে তুলেছিলো। ষাটে ‘স্বাক্ষর’ ও ‘কণ্ঠস্বরের’ মতো কাগজ কাব্যান্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। আমেরিকার বীট জেনারেশনের এ্যাংরি, পশ্চিমবঙ্গের ‘হ্যাংরি জেনারেশন’ এবং বাংলাদেশের ‘স্যাড জেনারেশন’ ধারাবাহিকতার পরম্পরা হিসেবে স্বীকৃত না হলেও তাদের চেতনা ও আদর্শের মিল লক্ষণীয়।

স্যাড জেনারেশনের একটি মাত্র বুলেটিন প্রকাশিত হলেও (১৯৬৪) ষাটের কবিতায় স্যাড জেনারেশনের কবিদের প্রভাব অনেকটাই। স্যাড জেনারেশনের সাথে সম্পৃক্ত কবিরাই প্রকাশ করেছেন ষাটের প্রধান লিটল ম্যাগাজিন ‘স্বাক্ষর’ ও ‘কণ্ঠস্বর’। ষাটের কবিদের প্রায় সবাই কোন না কোনভাবে এ দুটি কাগজের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন। তবে ষাটের কবিদের সবাই স্যাড জেনারেশনের ইস্তেহারের সাথে একাত্ম হননি, এমনকি স্যাডের কবিরাও সরে এসেছেন নিজেদের প্রতিজ্ঞা থেকে। ষাটের কবিরা ঋদ্ধ হয়েছেন দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবাদে। বাংলাদেশের ষাটের দশক রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবেও উত্তাল। সামরিক শাসন, শিক্ষাকমিশনবিরোধী আন্দোলন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ছয় দফা এবং এগারো দফার আন্দোলন এবং সর্বোপরি ৬৯-এর গণআন্দোলন ষাটের কবিদের চেতনাকে শানিত করেছে। ষাটের কবিরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যক্ষ করেছেন পরিণত চেতনায়। অনেকেই প্রত্যক্ষ যোদ্ধা হিসেবে অস্ত্র ধারণও করেছেন। ষাটের দশকে বাঙালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের উত্থান এবং জাতীয় বীরের গৌরব অর্জন ষাটের তারুণ্যেকে উদ্বেল করেছে, প্রাণিত করেছে। এপশভসব ঘটনাপঞ্জির ভেতর ষাটের দশকে কবি হিসেবে যারা আবির্ভূত হয়েছেন তাদের তালিকা নিতান্ত ছোট নয়।

ষাটের কবিদের নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে অনিবার্যভাবেই যাদের নাম উচ্চারিত হয়, তাদের অন্যতম প্রধান কবি অসীম সাহা। অসীম সাহার কাব্যজগতে আবির্ভাব ষাটের প্রথমার্ধে হলেও ঢাকার বাইরে অবস্থানের কারণে মূল ধারায় তাঁর প্রবেশ বিলম্বিত হয়েছে। নিজে বিভিন্ন সময় মিডিয়ার সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও অসীম সাহাকে মিডিয়ার আনুকূল্য পাওয়া কবি বলা যাবে না। কবিতা ছাড়াও অসীম সাহা অসংখ্য ঋজু গদ্য রচনা করেছেন। অসীম সাহার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে পূর্ব পৃথিবীর অস্থির জ্যোৎন্মায়’, ‘কালো পালকের নিচে’, ‘পুনরুদ্ধার’, ‘উদ্বাস্তু’, ‘মধ্যরাতের প্রতিধ্বনি’, ‘অন্ধকারে মৃত্যুর উৎসব’ এবং ‘মুহূর্তের কবিতা’, ‘ম-বর্ণের শোভিত মুকুট’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

ষাটের দশকের কবিতা বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সত্তর দশকের অন্যতম কবি আবিদ আনোয়ার ষাটের কবিদের চার শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। বিভক্তির ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত করেছেন তিনি অসীম সাহাকে। ‘ক’ শ্রেণিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন তিনি এভাবে : ‘ক’ শুদ্ধাচারী কবি, যারা সব দশকের প্রধান কবিদের মতোই বাংলা কবিতার আবহমান ছন্দ ও আঙ্গিকে নিবিষ্ট থেকেই নিজ নিজ পথে নতুনত্বের সন্ধান করেছেন। ‘আঙ্গিকের নিরীক্ষা যা করেছেন তাও ব্যাকরণদ্রোহিতার এক ধরনের ব্যাকরণ মেনেই করেছেন; সম্ভবত এরা মান্য করেন বুদ্ধদেব বসুর উদ্ধৃত টিএস এলিয়টের একটি অমোঘ উক্তিকে কবিতার নতুনত্ব একটি জীবিত বৃক্ষের ডালপালা বিস্তারের মতো, মূলকে অবলম্বন করেই যার বিস্তৃতি ও বিকাশ (ষাটের দশকের কবিতার আধার ও আধেয় ॥ আবিদ আনোয়ার ॥ আবিদ আনোয়ার রচিত গোটা রচনার সাথে সর্বাংশে একমত না হলেও কবি অসীম সাহার এই শ্রেণিভুক্তিকে যথার্থ বলেই মেনে নিয়েছি।

অসীম সাহার কবিতায় ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সমকাল যেমন উচ্চারিত হয়েছে, একইভাবে তাঁর কবিতায় ‘পুরাণ’ এসেছে বারবার অনুষঙ্গ হয়ে; সে পুরাণ কখনো দেশজ কখনো বা বৈশ্বিক। অসীম সাহার কবিতায় ছন্দ ও কবিতার প্রকরণ বিষয়ে নিষ্ঠা প্রত্যক্ষ করা গেলেও তাঁকে স্থুল অর্থে কলাকৈবল্যবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। একজন আধুনিক কবির সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান অসীম সাহার কবিতায়; বরং তাঁকে বলা যায় প্রকরণ-নিষ্ঠ আধুনিক কবি। তাঁর আধুনিকতায় যেমন হঠকারিতা নেই, তেমনি নেই উন্নাসিকতাও। উত্তরাধুনিকতার নামে তিনি কখনো তাঁর পরম্পরাকে অস্বীকার করেন না; বরং বাংলা কবিতায় ত্রিশোত্তর আধুনিকতার প্রবল ধারার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। ছন্দনিষ্ঠ হবার কারণে তাঁর গদ্যরীতিতে লেখা কবিতাও পাঠকের অন্তরে এক অনির্বচনীয় দোলার সৃষ্টি করেজন্ম নেয় এক স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনা।

অসীম সাহার প্রথম কাব্যগ্রন্থ পূর্ব-পৃথিবীর অস্থির জ্যোৎন্মায়’-এর ‘বিরহকাতর এক দগ্ধ বাউলিনী’ কবিতায় সমুদ্র উপকূলে বসে থাকা, ধুলোবালি মাখা, রুক্ষ, এলোমেলো এক বাউলিনীর মধ্যে তিনি বিপন্ন স্বদেশকে আবিষ্কার করেন।

কবির সংবেদনশীল হৃদয়ের সন্ধান পাই একই কাব্যের ‘বিবেক’ কবিতায়। পরিপার্শ্বের অসঙ্গতি উচ্চারিত হতে দেখি তাঁর কবিতার পংক্তিতে। আবেগের স্পর্শকাতরতা প্রত্যক্ষ করি তাঁর ‘শানানো ছুরির নিচে’ কবিতায়। এই কবিতাটি পড়ে উপলব্ধি করা যায় তাঁর কাব্যনির্মিতির মুন্সিয়ানা। যে কোন বিষয়কে উত্তীর্ণ কবিতা করে তোলায় কবির পারঙ্গমতা প্রত্যক্ষ করি এ কবিতায়। ‘কখনো-কখনো অসহায় পশুর চিৎকারে

অসীম সাহার ‘পুনরুদ্ধার’ এবং ‘মুহূর্তের কবিতা’ কাব্যে কবির মাত্রাবৃত্তের প্রতি দুর্বলতা লক্ষ করা যায়। মাত্রাবৃত্তের দোলা দেখি ‘উদ্বাস্তু’ কাব্যেও। এই কাব্যে ‘উদ্বাস্তু’ শিরোনামের সিরিজ কবিতা ছাড়াও বেশ কিছু কবিতায় এ-অঞ্চলের দেশত্যাগী মানুষের মর্মন্তুদ বেদনার কথা বিবৃত হয়েছে। ‘মধ্যরাতের প্রতিধ্বনি’ কাব্যেও গৃহহারা-স্বজনহারা মানুষের হাহাকারের প্রতিধ্বনি শুনি। সেই সব মর্মন্তুদ কাহিনীর কোনটিই আমাদের অজানা নয়।

অসীম সাহার ‘অন্ধকারের মৃত্যুর উৎসব’ কাব্যে বিধৃত হয়েছে সমকাল, যে সমকালে একদিকে যেমন ২০০১-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশব্যাপী অনাচার, দুবৃত্তায়নের ছবি আছে, তেমনি আছে একজন তসলিমা নাসরিন-এর সাহসী উচ্চারণের পক্ষে কথাও। ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের মতো অসভ্যতার বিরুদ্ধে যেমন তিনি সোচ্চার হয়েছেন, একইভাবে মানবতার পক্ষে বলেছেন নিজের অঙ্গীকারের কথাও। নানা অসঙ্গতি অনাচারে রক্তাক্ত একজন সংবেদনশীল কবির সাহসী উচ্চারণ তাই কবিতার পাশাপাশি ইতিহাসেরও অংশ হয়ে যায়। অন্ধকার সময়কে উপস্থাপন করেন তিনি বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায়।

বিভিন্ন অনুষঙ্গ, প্রতিবাদ, জটিল স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ উচ্চারিত হলেও অসীম সাহার কবিতার প্রধান এবং প্রবল প্রবণতা প্রেম। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলোর প্রায় সবগুলোতেই প্রেমের কবিতা উপস্থাপিত। তাঁর ‘পুনরুদ্ধার’ কাব্যের ‘দিয়েছি দু’হাত বাড়িয়ে’, ‘দৃষ্টি’, ‘ইচ্ছে করে’, ‘প্রত্যাখ্যান’, ‘উদ্বাস্তু’ কাব্যের ‘উপেক্ষা’, ‘চাওয়া-পাওয়া’, ‘তুমি দাও’, ‘মধ্যরাতের প্রতিধ্বনি’ কাব্যের ‘গতি’সহ অসংখ্য কবিতার উদ্ধৃতি দেয়া যায়।

কিন্তু ‘মুহূর্তের কবিতা’ কবি অসীম সাহার পরিণত বয়সের প্রেমের কবিতা সংকলন। স্বল্প সময়-পরিধির অল্প কটি কবিতায়ই কবির প্রেমাকুতি, চাওয়া-পাওয়া এবং আবেগ-বেদনা উচ্চারিত। সবকটি নিটোল প্রেমের কবিতাই হৃদয়াবেগে স্পর্শকাতর। দয়িতার অলিঙ্গন পেতে কবি যেমন বকুলবৃক্ষ হয়ে জন্মাতে চান, তেমনি তৃষ্ণায় জলধারা পেতে মাটিত শয্যা পেতে রাখেন। কবির পরিণত বয়সের এই তারুণ্যদীপ্ত আবেগ পাঠককে আলোড়িত করার মতোই। এ কাব্যেও কবির ছন্দের কারুকাজ লক্ষযোগ্য। প্রেমের এই কাব্য থেকে অসংখ্য ভালোলাগার মতো পংক্তি উদ্ধার করা যায়। অসীম সাহার কবিতায় যে বৈচিত্র্যের ঋদ্ধি তা তাঁর মুহূর্তের কবিতা কাব্যপাঠে জানা যায়।

প্রকৃতপক্ষে অসীম সাহা নিত্য তারুণ্যের হাত ধরে কবিতার অঙ্গনে হাঁটেন এবং প্রতিদিন থাকেন আধুনিক আর সমকালীন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়