কাকন রেজা : ভেনিজুয়েলাকে কেন্দ্র করে বিশ্ব আবার স্নায়ুযুদ্ধের অবস্থায় পৌঁছেছে। ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে সেখানে। সরকার ও সরকার বিরোধীদের সংঘর্ষে বিগত সপ্তাহে ২০ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে গণমাধ্যমগুলো। সরকারের পক্ষে নিরাপত্তারক্ষীদের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের খবরও এসেছে মাধ্যমগুলোতে। এ অবস্থায় বিরোধীপক্ষের নেতা হুয়ান গাইডো সরকারে থাকা নিকোলাস মাদুরোর বিপরীতে নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছেন। সমর্থনও মিলেছে চটজলদি। যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে পরে ব্রিটেন, কানাডাসহ বেশ কয়েকটি দেশ গাইডোকে সমর্থন জানিয়েছে।
অপরদিকে রাশিয়া, চীনসহ কটি দেশ মাদুরোকে সমর্থন জানিয়ে এবং জুগিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলার হুমকির প্রেক্ষিতে মাদুরোকে রক্ষায় রাশিয়া সেনাও পাঠিয়েছে দেশটিতে। পরিস্থিতিটা স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ে সাথে মিলে যায়, আশঙ্কা হয় আরেকটি বিশ্বযুদ্ধেরও।
আফ্রিকার তেলসমৃদ্ধ একটি দেশ ভেনিজুয়েলা। অথচ সরকারের অব্যবস্থা, দুর্নীতির কারণে দেশটির সামগ্রিক অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। সাথে ভেঙে পড়েছে রাজনৈতিক কাঠামোও। মূলত সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর ভর করে চলছে দেশটির মাদুরো সরকার। সরকার বিরোধীরা সেনাবাহিনীর প্রতি আর্জি জানিয়েছে, তারা যেন দেশের সংবিধান ও জনগণের পক্ষে থাকে। কিন্তু মাদুরো সরকারের কাছে ‘আনডিউ প্রিভিলেজ’ পাওয়া সেনাবাহিনী কতোটা সংবিধান বা দেশের মানুষের পক্ষে থাকবে সেটাই ভাবার বিষয়। অবশ্য সেনাবাহিনীর এক সাবেক কর্মকর্তার মতে, সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা রক্ষীদের ওপর বেশি নির্ভর করায় মাদুরো সরকার রাজনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজের সমর্থন হারিয়েছে। এই হলো মোটামুটি ভেনিজুয়েলার অবস্থা এবং দেশটিকে কেন্দ্র করে বিশ্ব রাজনীতির সাম্প্রতিক পরিস্থিতি। এতে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে, বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ ইউরোপের বেশ কিছু দেশ এক কাতারে অবস্থান নিয়েছে। বিপরীত মেরুতে রয়েছে রাশিয়া, চীন, ইরান, তুরস্কের মতন দেশগুলো। বিশ্ব নামক এই ‘গ্লোবাল ভিলেজে’ এখন আর কেউই ‘গ্লোবাল পলিটিক্সে’র বাইরে নয়। এখানে হয় এই পক্ষ, নয় ওই পক্ষের হতে হয়, হবে। আমাদের দেশের কেউ কেউ নানা কারণে বিদেশমুখি হন। এমন ‘মুখি’দের ধারণা বিদেশিরা তাদের অবস্থানকে সমর্থন করবেন এবং তা ন্যায়সঙ্গত কারণেই। ‘ন্যায়বোধে’র এমন ধারণা হালের রাজনীতিতে পরিত্যাজ্য। যারা রাজনীতির ন্যায়টাকে ‘ন্যায্যতা’র দৃষ্টিভঙ্গিতে মাপেন, হালফ্যাশনে তারাও ব্যাকডেটেড।
আরেকটি উদাহরণে বিষয়টিকে সহজ করে দিই। বাহরাইনে বিরোধীদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ জানিয়েছে ইরান। দেশটির সরকারকে এ কারণে দোষারোপ করা হয়েছে ইরান সরকারের তরফ থেকে। অথচ ইরানের বর্তমান মিত্র চিনে চলছে উইঘুর সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর চরম নির্যাতন। ইসলামি বিপ্লবের দাবিদার ইরান হয়তো বিস্মৃত হয়েছে, উইঘুর’রা ধর্মে মুসলিমও। এমন নির্যাতনে ইরানের তেমন কোনো ‘রা’ নেই।
কেন নেই, এই প্রশ্নটা করলেই বোঝা যাবে, বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে ভালো-মন্দ বলতে আসলে কিছু নেই। এখানে শুধু শাসকদের স্বার্থ আর ক্ষমতালিপ্সাই মুখ্য। অনেক সময় দেশও গৌণ সেখানে। ভেনিজুয়েলার মাদুরোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ ন্যায়-নৈতিকতার প্রশ্নে নয়, রাজনীতির জন্যও নয়। ভেনিজুয়েলা থেকে উত্তোলনকৃত তেলের এক তৃতীয়াংশ যায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। সেখানের শাসক যদি যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ে না থাকে, বৃত্তবন্দী না হয়, তাহলে তো সমস্যা। বলয় আর বৃত্তবন্দীর এই খেলাতেই যুগে যুগে বিশ্বে সৃষ্টি হয়েছে অস্থির অবস্থার। যাতে প্রধানত আক্রান্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ। শুধু ভেনিজুয়েলা বা বাহরাইনই নয়, মিলিয়ে দেখুন মানচিত্রের অধিকাংশ জায়গার চিত্রই প্রায় এক। দক্ষিণ এশিয়া, ল্যাটিন অ্যামেরিকা কিংবা আফ্রিকা কোনো ভূমিই বাদ নেই বৃত্তবন্দীর এই খেলায়। গ্লোবাল পলিটিক্সের ত্রুরতা আর কুটিলতার খেলায় মানবতা, অধিকার, ন্যায্যতা, নিরপেক্ষতা, ধর্ম কেবলই অসহায় উপকরণ মাত্র।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট