যুগান্তর : চলতি অর্থবছরের ঘোষিত মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রা থেকে বহুদূরে অবস্থান করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে বেশির ভাগ লক্ষ্যমাত্রাই অর্জিত হয়নি। এর মধ্যে মুদ্রানীতির মৌলিক উপকরণ বাজারে টাকার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ, অভ্যন্তরীণ ঋণ, সরকারি ও বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এমন কি মুদ্রানীতির উপকরণগুলোও সঠিকভাবে কাজ করছে না। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই ৩০ জানুয়ারি নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, মুদ্রানীতির যেসব লক্ষ্য অর্জিত হয়নি সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গবেষণা করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এর কারণ শনাক্তের মাধ্যমে এর সমাধান করা না হলে মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন কঠিন হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, মুদ্রানীতির লক্ষ্য অর্জিত হয়নি বলা যাবে না। লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে, তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে শতভাগ অর্জিত হয়নি। তিনি বলেন, মুদ্রানীতির লক্ষ্য সব সময় বেশিই ধরা হয়। তাতে কাছাকাছি গেলেও আমরা সন্তুষ্ট।
সূত্র জানায়, নতুন মুদ্রানীতিতে উৎপাদন খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়ানো ও ভোগ-বিলাসে ঋণের লাগাম টেনে ধরার উদ্যোগ নেবে। এর মধ্যে বড় শিল্পের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকেও গুরুত্ব দেয়া হবে। বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য নারী উদ্যোক্তা তৈরিকে প্রাধান্য দেয়া হবে। মূল্যস্ফীতির হারকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়োজনীয় উদ্যোগও থাকবে। এসব বহুমুখী পদক্ষেপের মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়ানো, নতুন কর্মসংস্থান তৈরির সুযোগ সৃষ্টির পদক্ষেপ নেয়া হবে। এসব কাজে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি সরকারের অন্যান্য সংস্থাকেও সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে সরকারের উচ্চপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি অর্থবছরে দু’দফায় মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। প্রথমে বাজেট প্রণয়নের পর জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদের মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। তবে ওই সময়ে পুরো অর্থবছরের একটি লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করা হয়। ডিসেম্বরের পর মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের অবস্থা পর্যালোচনা এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ঘোষিত মুদ্রানীতি প্রয়োজন অনুযায়ী সংশোধন করে।
জাতীয় নির্বাচনের পর এবার চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষিত হচ্ছে। এ কারণে এ মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের প্রত্যাশা রয়েছে ঋণ প্রবাহ বাড়ানো হবে। বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে। ফলে বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ানোর একটি চাপ অনুভব করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এদিকে টাকার প্রবাহ বাড়লে সেগুলো ভোগ-বিলাসে গিয়ে যাতে মূল্যস্ফীতির হার বাড়াতে না পারে সেদিকে নজর রাখছে। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাচ্ছে টাকার প্রবাহকে উৎপাদনমুখী করতে।
চলতি অর্থবছরের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ২ শতাংশ। ওই সময় পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে ৪ দশমিক ০৯ শতাংশ। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অর্ধেকের কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে অর্জিত হয়েছিল ১০ দশমিক ৯ শতাংশ।
জুন পর্যন্ত বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়াতে চায় ১২ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে অর্জিত হয়েছিল ৯ দশমিক ২ শতাংশ। ডিসেম্বর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ। ওই সময়ে অর্জিত হয়েছে ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে অর্জিত হয়েছিল ১১ দশমিক ২ শতাংশ। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধির হার কমেছে প্রায় অর্ধেক। একই সঙ্গে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ কম।
জুন পর্যন্ত এ হার ১৫ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত করার কথা রয়েছে। গত অর্থবছরের জুন পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহ বেড়েছিল ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। গত বছরের চেয়ে এবার অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহ আরও বাড়াতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ ৮ দশমিক ৬ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এর বিপরীতে এ সময়ে বেড়েছে ৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারি ঋণ বেড়েছে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকের চেয়ে কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে ঋণ প্রবাহ কমেছিল ১৩ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের জুন পর্যন্ত সরকারি খাতের ঋণ ৮ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে ঋণ প্রবাহ কমেছিল আড়াই শতাংশ।
চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। ওই সময় পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ। যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বেড়েছিল ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ ১৬ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত করতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে ঋণ প্রবাহ বেড়েছিল ১৭ শতাংশ।
মুদ্রানীতির প্রভাব সম্পর্কে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, শুধু দেশে নয়, বৈশ্বিকভাবে অর্থনীতিকে মুদ্রানীতি খুব বেশি প্রভাবিত করতে পারছে না। বরং অর্থনীতিকে মুদ্রানীতির বাইরের বেশ কিছু অনুষঙ্গ অনেক বেশি প্রভাবিত করছে। সুশাসনের ঘাটতি এবং উচ্চ খেলাপি ঋণ অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। যদিও এগুলো মুদ্রানীতির অংশ নয়। একই ভাবে সুদের হারের অনেক প্রভাব। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। আমানতের গতি মন্থর। এছাড়া অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ-গ্যাস। যা বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে। এসব বিষয় দেশের অর্থনীতিকে সরাসরি প্রভাবিত করলেও মুদ্রানীতিকে পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঘোষিত মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমানোর লক্ষ্য নিয়েছিল। কিন্তু অর্থবছরের শুরু থেকে কিছুটা কমলেও ডিসেম্বরের শেষে তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। এদিকে মুদ্রানীতির বিভিন্ন উপকরণের হার কমিয়ে সুদের হার কমানোর সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু বাজারে সেগুলো কোনো ইতিবাচক বার্তা দিতে পারেনি।
বৈদেশিক সম্পদের পরিমাণ কমে যাওয়ায় সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে ঘাটতি রেকর্ড পরিমাণে ওঠে। যে কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারে চাপে পড়ে। এতে আমদানি খাতে ব্যয় বেড়ে যায়। তবে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতেও সহায়ক ভূমিকা রাখছে।