নয়া দিগন্ত : ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির শক্তির ভরকেন্দ্র উত্তর ভারতের হিন্দি ভাষাভাষী কয়েকটি রাজ্য। সেরকম তিনটি রাজ্য -রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তিশগড় মঙ্গলবার বিরোধী কংগ্রেসের কাছে হারিয়ে ফেলার পর ২০১৯ এর ভারতের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি আবার উতরাতে পারবে কিনা সে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
দিল্লিতে সাংবাদিক শুভজ্যোতি ঘোষ বলছেন, লোকসভা নির্বাচনের মাত্র কয়েকমাস আগে তাদের 'হার্ট-ল্যান্ডে' এই নির্বাচনী বিপর্যয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে বিজেপির মধ্যে।
দলের অন্যতম মুখপাত্র কে জে আলফনসো বলেছেন, "আমাদের এখন ড্রয়িং বোর্ডে ফিরে গিয়ে দেখতে হবে, কোথায় সমস্যা হয়েছে।"
কী সমস্যা হলো বিজেপির যে তাদের সবচেয়ে অনুগত ভোটাররা দলকে প্রত্যাখ্যান করলো? চার বছরের মাথায় নরেন্দ্র মোদীর সম্মোহনী শক্তিতে কি তাহলে ঘুণ ধরতে শুরু করেছে? দিল্লীতে লেখক কলামিস্ট নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়, যিনি নরেন্দ্র মোদীর জীবনী লিখেছেন তিনি বলছেন, 'মোদী ম্যাজিক' শেষ হতে চলেছে কিনা এখনই বলা কঠিন, তবে মঙ্গলবারের নির্বাচনী ফলাফল বিজেপির জন্য অবশ্যই একটি অশনি সঙ্কেত।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তিসগড়ের ৬৫টি আসনের ৬২টি জিতেছিল বিজেপি। কিন্তু মঙ্গলবারের বিধানসভার ফলাফলের চিত্র যদি আগামী লোকসভা নির্বাচনেও দেখা যায়, তাহলে এই তিনটি রাজ্য থেকে বিজেপির আসন আসবে বড়জোর ৩০টি।
কেন এই পরিণতি?
নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় কয়েকটি কারণের কথা বললেন:
ভারতে কৃষকের ওপর চাপ দিন দিন বাড়ছে এবং বিজেপি সরকার সেটিকে গুরুত্ব দিচ্ছেনা। "কোনো কোনো রাজ্যে কৃষকদের আত্মহত্যার প্রবণতা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে।" ফলে, কৃষকরা ব্যাপক সংখ্যায় বিজেপির কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
কৃষকরা যে তাদের উৎপাদিত পণ্যের দাম পাচ্ছেনা সে সম্পর্কে উদাহরণ দিতে গিয়ে শুভজ্যোতি ঘোষ বলছেন, বেশ কয়েকটি রাজ্যে কৃষকরা এখন পাইকারদের কাছে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি করছে বড় জোর এক রুপীতে। "দিল্লীতে এসে সেটা হয়ত ২০ রুপি হচ্ছে, কিন্তু কৃষক পাচ্ছে এক রুপী।"
দ্বিতীয়ত, নোট বাতিল (ডিমনিটাইজেশন) ছোট-বড় ব্যবসা, কারখানা এবং সেই সাথে কৃষকদের ভীষণ ক্ষতি করেছে।
পশ্চিমবাংলা, বিহার এবং ওড়িশ্যা থেকে যেসব কৃষি শ্রমিকরা উত্তর ভারতে কাজ করতে আসতেন, নোট বাতিলের পর তাদের মজুরী দিতে বড় কৃষকদের কষ্ট হয়েছে। ফলে অনেক শ্রমিক চলে গিয়েছিল, তাদের অনেকেই আর ফিরে আসেনি।
তৃতীয়ত, শহরাঞ্চলে বেকারত্ব মধ্যবিত্ত সমাজকেও ক্ষুব্ধ করেছে। ২০১৪ নির্বাচনে জেতার পর মি মোদী 'মেক ইন্ডিয়া' নামে এক প্রকল্পের ঘোষণা দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ না আসায়, চাকুরীর সুযোগ তৈরি হয়নি।
কৃষক অসন্তাষের সাথে যোগ হয়েছে দলিত অর্থাৎ নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ক্ষোভ।
গোরক্ষার নামে যে শুধু মুসলমানরাই হামলার শিকার হচ্ছে তাই নয়, দলিতদেরও নানা হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। সেকারণে, তিনটি রাজ্যেরই দলিত এবং আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার ভোটাররা বিজেপিকে ভোট দেয়নি।
নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলছেন, "এসব কারণে এমন একটি ইমেজ বিজেপি সরকারের সম্পর্কে তৈরি হয়েছে যে তারা শুধু প্রতিশ্রুতির ফুলকি ছোটায়, কিন্তু তার পূরণে কিছু করেনা। ফলে হিন্দুত্ববাদ এই তিন রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপিকে খুব বেশি রাজনৈতিক সুবিধা দিতে পারেনি।"
যেমন, ভারতের একমাত্র গো-মন্ত্রী ওতারাম দেওয়াসি হেরে গেছেন দশ হাজার ভোটের ব্যবধানে।
নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলছেন, এই অসন্তোষের ইঙ্গিত গত বছর থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল। গত বছর ডিসেম্বরে মোদীর নিজের রাজ্য গুজরাটে খুব কষ্টে জিততে হয়েছিল বিজেপিকে। পুরো ২০১৮ সাল ধরে বিভিন্ন রাজ্যে লোকসভা এবং বিধান সভার যে সব উপনির্বাচন হয়েছে, তার ৯০ শতাংশই বিজেপির বিপক্ষে গেছে।
বিজেপির শক্তির আরেকটি ভরকেন্দ্র উত্তর প্রদেশের অবস্থাও সুবিধার নয়। সেখানেও অসন্তোষ বাড়ছে।
তার মতে, নরেন্দ্র মোদী যদি দ্রুত নাটকীয় কোনো বিকল্প রাজনৈতিক কৌশল হাজির না করতে পারেন, তাহলে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পাওয়া ২৮২ আসন দেড়শ থেকে ১৮০ তে নেমে আসতে পারে।
হিন্দুত্ববাদে রাশ টানবেন মোদী?
কিন্তু আগামী কয়েক মাসে নতুন কী কৌশল তার থলে থেকে বের করতে পারবেন নরেন্দ্র মোদী? কট্টর হিন্দুত্ববাদের রাজনীতিতে রাশ টানার সম্ভাবনা কি রয়েছে?
নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলেন, সে সম্ভাবনা কম। তিনি বরঞ্চ মনে করেন, হিন্দুত্ববাদের প্রচারণা আগামীতে জোরদার করতে পারে বিজেপি।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরোলো কথাবার্তা শোনা যেতে পারে। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ইস্যুকে আরো জোরালোভাবে সামনে আনা হতে পারে। কিন্তু এসব করে আগামী তিনমাসে ২০১৪ নির্বাচনের আগের সেই 'মোদী ম্যাজিক' কতটা শাণিত করতে পারবেন নরেন্দ্র মোদী, তা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ করছেন।
আপনার মতামত লিখুন :