মঞ্জুরুল আলম পান্না : বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দলীয় কোনো সরকারের অধীনে অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ একটা নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনাকে সবার কাছে আকাশ কুসুম কল্পনা মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। এমন নির্বাচনের স্বপ্ন কেউ হয়তো ঘুমের মধ্যেও দেখার সাহস পান না। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, ‘স্বপ্ন তা-ই যা মানুষকে ঘুমোতে দেয় না’। সন্ত্রাসমুক্ত-রক্তপাতহীন-কারচুপিবিহীন নির্বাচনের সেই স্বপ্ন কিংবা দুঃস্বপ্ন এখন দেশের কোটি কোটি মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। কেননা রাজনীতি এখন রাজপথ থেকে শুরু করে মানুষের শয়নকক্ষের সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের নিকট এবং সুদূর রাজনৈতিক ভবিষ্যতের চেহারা কেমন হতে যাচ্ছে তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-আশা-আকাক্সক্ষার দোলাচলে প্রতিটি সাধারন মানুষ। এই নির্বাচনকে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারা ও আইনের শাসনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের শেষ সুযোগ বলে মনে করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো সংস্থাগুলো। দলীয় সরকারের অধীনে এবং এক দশক পরে একটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাওয়ায় অনেক ধরনের আশঙ্কার মধ্যেও বাদ্য বাজনার ধুম লেগেছে যেন পুরো বাংলাদেশ জুড়ে। প্রতীক বরাদ্দের পরপরই শুরু হয়ে গেছে নির্বাচনী প্রচারণার মহাযজ্ঞ।
প্রতি মুহূর্তে আমি স্বপ্ন দেখছিÑ ‘কোনো প্রার্থীর প্রচারণায় বিরোধী কোনো প্রার্থী কোনো ধরনের বাঁধা দিচ্ছেন না, বরং দুই প্রার্থীর মিছিল মুখোমুখি হলে একে অন্যকে পথ করে দিচ্ছেন নির্বিঘেœ যাওয়ার জন্যে; কেউ কারোর ওপর হামলা করছে না; যে রক্তপাতের আশঙ্কা করা হচ্ছে তা মিথ্যে হয়ে দেখা দিচ্ছে প্রতি মুহূর্তে; কোনো সন্ত্রাসীর দেখা মিলছে না কোথাও, বোমা নেই, গুলি নেই, রক্ত নেই; মার্কা দেখে নয়, মানুষ ভোট দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন প্রার্থীর সততা আর যোগ্যতা দেখে; নির্বাচন কমিশন কারোর রক্তচক্ষুকে ভয় পাচ্ছেন না, সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে যা যা করার করে যাচ্ছে; প্রশাসনের ওপর অন্যায় কোনো চাপ নেই; সরকারি দলের কোনো প্রার্থী প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন না; ভোটের দিন পেশিশক্তির কোনো প্রার্থী কারচুপির আশ্রয় নিলেও পুলিশ তা প্রতিহত করছে পেশার পবিত্রতা রক্ষা করে; মানুষ সারিবদ্ধভাবে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে একে একে নির্বিঘেœ ভোট দিয়ে খুশি মনে বাড়ি ফিরছেন; গণমাধ্যমও কারোর প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করে পেশাদারিত্বের সঙ্গে সংবাদ পরিবেশন করছে জাতির বিবেক হয়ে’।
এমন স্বপ্ন দেখাতে যে কেউ আমাকে বদ্ধ উন্মাদ ভাবতেই পারেন। একটা শুভ্র সুন্দর স্বপ্নের জন্য নিজেকে পাগল বলে স্বীকার করে নিতেও রাজি আছি। কিন্তু একইসঙ্গে প্রশ্নÑ এমন একটা স্বপ্নের বাস্তবায়ন কি আসলেই অসম্ভব কিছু? এই বাংলাদেশে একদিন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে, তা কি ভেবেছিলো কেউ কোনোদিন? বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের যে বিচার হবে, তাও কি ভাববার সাহস ছিলো কারোর, কোনো এক সময়? আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু গড়ে উঠবে, মাত্র কদিন আগেও কি সেই স্বপ্ন দেখার সাহস ছিলো কারোর? নিশ্চিত জানি, নির্বাচন নিয়ে আমার মতো আরও অনেকের দেখা ‘ঘুম তাড়ানিয়া স্বপ্ন’ এদেশে একদিন সত্যিই সফল হবে। তবে সেটি কেন এবারই নয়? একজন ব্যক্তি চাইলেই কেবল সেটি হতে পারে, তিনি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কারণ তিনিই বলেছেন তার ওপর আস্থা রাখতে। দুই যুগ আগে তার একটি কথা খুব মনে পড়েÑ ‘গণতন্ত্র এখন একটি নবজাতক শিশু, একে বাাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলের’। দুই যুগে নবজাতক শিশুটি কতোটুকু হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে তা সবাই জানি! তার ওপর দিয়ে অনেক ঝড়ঝাপ্টা গেছে, হায়েনার আক্রমণ গেছে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পূর্বশর্ত একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। বঙ্গবন্ধুকন্যা কি আমাদের সেই রুগ্ন-ক্লান্ত নবজাতককে আবার সুস্থ করে সত্যি সত্যিই উচ্চারণ করতে পারেন নাÑ ‘এই দ্যাখো, আমি কথা দিয়েছিলাম, কথা রেখেছি। কারণ আমার ধমনীতে বঙ্গবন্ধুর রক্ত। জয় বাংলা’।
লেখক : সাংবাদিক