বিভুরঞ্জন সরকার : সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মন ভালো নেই। শরীরও ভালো নেই। একসময় যিনি ছিলেন দোর্দ- প্রতাপের অধিকারী, সেই সামরিক শাসক নাকি এখন সন্ধ্যা নামলে ভয় পান, একা থাকতে ভয় পান। তিনি বাসায় না থেকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে রাত কাটাতে যান। তার বয়স হয়েছে। ১৯৩০ সালে জন্ম হলে এখন তার বয়স ৮৮ বছর। একেবারেই পরিণত বয়স। এই বয়সে যতোটুকু ভালো থাকার কথা এরশাদ হয়তো তারচেয়েও অধিক ভালো আছেন। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাকে ভালো থাকতে দিচ্ছে না। শরীরের সঙ্গে মনের সম্পর্ক নিবিড়। মন খারাপের প্রভাব যেমন শরীরে পড়ে, তেমনি শরীর ভালো না থাকলে মনও ভালো থাকে না। এরশাদের এখন শরীর-মন দুটোই খারাপ যাচ্ছে। তিনি এই হাসপাতালে তো এই বাসায়। তার স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্য কি কারো কাছে আছে? তার দলের নেতারা একবার বলছেন, তিনি শতভাগ সুস্থ, আবার বলছেন, তার চিকিৎসা দরকার। চিকিৎসার জন্য তার দেশের বাইরে যাওয়ার কথাও বলা হচ্ছে।
এরশাদের জাতীয় পার্টিকে যদি আওয়ামী লীগ ৫০/৬০টি আসন ছেড়ে দিতো, তাহলে আমি নিশ্চিত, তিনি ভালো থাকতেন এবং তাকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে হতো না। তাকে সিএমএইচেও ভর্তি হতে হতো না। কিন্তু আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে এরশাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী আসন না ছাড়ায় সব তালগোল পাকিয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত কয়টি আসন জাতীয় পার্টিকে দেওয়া হবে, সেটা চূড়ান্ত হওয়ার পরই এরশাদের স্বাস্থ্য বিষয়ক জটিলতার কিছুটা নিরসন হতে পারে। এর মধ্যেই দলের মহাসচিব পদে রদবদল ঘটেছে। রহুল আমিন হাওলাদার আউট। মশিউর রহমান রাঙা ইন। নাটকীয়তা হয়তো আরো কিছু বাকি আছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বিস্ময়ের নাম এইচ এম এরশাদ। তিনি এক অঙ্গে বহুরূপ ধারণ করেন। তার মতো নিন্দা যেমন অন্য কোনো সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের ভাগ্যে জোটেনি, তেমনি এতো নিন্দিত-বিতর্কিত হয়েও দেশের রাজনীতিতে একটি আলোচিত নাম হিসেবেই তিনি আছেন ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য হওয়ার ২৮ বছর পরেও। তিনি ক্ষমতা দখল করেছিলেন বন্দুকের জোরে ১৯৮২ সালে। ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখে তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর। নরমে-গরমে প্রায় আট বছর দেশ শাসন করেছেন তিনি। তার শাসনামলে তার বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন হয়েছে। ছাত্রদের মিছিলে ট্রাক উঠিয়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সেলিম-দেলোয়ারকে হত্যা করা হয়েছিলো। হত্যা করা করা হয়েছিলো শ্রমিক নেতা তাজুল ইসলামকে। বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান লেখা নূর হোসেনকে টার্গেট করে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিলো। হত্যা করা হয়েছিলো ডা. মিলনকে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। এরশাদকে বিদায় নিতেই হয়েছিলো। তবে স্বৈরশাসক হিসেবে এরশাদের কপালে যে কলঙ্কচিহ্ন আঁকা হয়েছিলো তিনি তা থেকে মুক্তি পাননি কখনও। এরশাদের আগে ক্ষমতা জবর দখল করেছিলেন সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান। জিয়া নির্বাচনে জিতে বা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আহরণ করেননি। তিনিও বন্দুকের জোরেই ক্ষমতায় বসেছিলেন। জিয়া কীভাবে ক্ষমতা কব্জা করেছিলেন তার বিবরণ আছে বিচারপতি সায়েমের স্মৃতিকথায়। অথচ এরশাদকে যেভাবে স্বৈরশাসক বলে বর্ণনা করা হয়, জিয়াকে সেভাবে নয়। সেদিক থেকে জিয়া সৌভাগ্যবান। এরশাদ ভাগ্য বিড়ম্বিত।
সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ বিরোধ বা ক্ষমতার অন্তঃকলহে জিয়ার মৃত্যু না হলে ক্ষমতা থেকে তার বিদায় কীভাবে হতো, সেটা এখন বলা মুশকিল। তবে তিনি যে সেভাবে জনপ্রিয় শাসক ছিলেন না সেটা বলা যায়। একটি ট্র্যাজিক মৃত্যুই বরং জিয়াকে অনেক বেশি জনপ্রিয় করে তুলেছে। যা পুঁজি করে তার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি দাপটের সঙ্গে রাজনীতির ময়দানে অবস্থান করছে।
এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন আন্দোলনের মাধ্যমে। তাকে মনে করা হয় সবচেয়ে অজনপ্রিয় শাসক। তার ব্যক্তিগত স্বভাব-চরিত্র নিয়েও হাসি-কৌতুকের শেষ নেই। ভাবা হয়েছিলো ক্ষমতাচ্যুতির পর এরশাদ এবং তার গড়া দল জাতীয় পার্টির জায়গা হবে আস্তাকুঁড়ে। কিন্তু না, এরশাদ এবং তার দল বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজও প্রাসঙ্গিক। চির প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই দলের কাছেই এরশাদের সমান কদর। দুই দলের কাছ থেকে প্রশ্রয় পেয়ে জাতীয় পার্টি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে টিকে আছে।
এরশাদের দাম্পত্যজীবন নিয়ে কথা থাকলেও জাতীয় পার্টির এখন যৌথ মালিকানা। স্ত্রী রওশনের সঙ্গে দলের মালিকানা ভাগাভাগি করে কোনো রকমে চলতে হচ্ছে এরশাদকে। একসময় মনে করা হতো এরশাদ আওয়ামী লীগ ঘেঁষা আর রওশনের পক্ষপাত বিএনপির প্রতি। গত নির্বাচনের সময় তাদের পক্ষ বদল ঘটে। এরশাদ বাউলি মারতে চাইলেও রওশন আওয়ামী লীগের দিকে ঝোঁকেন। এরশাদ নানা নাটকীয়তা শেষে স্ত্রীর বশ্যতা মেনেই রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন। আর একবার সরকার প্রধান হওয়ার বড় খায়েশ তার। সাধ আছে, সাধ্য নেই। তিনি কখনও আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলেন। আবার কখনও সরকারবিরোধী ভূমিকা নিতে চান। শক্তি-সামর্থ্য না থাকায় যা করতে চান তা করতে পারেন না। আছে মামলার ভয়। বয়সের ভার।
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এরশাদ হয়তো কোনো চমক দেখাতে চেয়েছিলেন। পক্ষ বদলের হমকি দিয়ে আওয়ামী লীগকে হয়তো চাপে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা সব সময় পাল্টা চাল দিতে পারদর্শী। তিনি সম্ভবত এবার এরশাদকে আরও ‘সাইজ’ করতে চান। তাই জাতীয় পার্টিকে ছোট করে আনার ব্যবস্থা তিনি করছেন। এরশাদ চোখের সামনে তার পরিণতি দেখছেন। আর ছটফট করছেন। হাত-পা যার বাঁধা, নীরবে মার খাওয়া ছাড়া তার আর কি করার আছে?
লেখক : গ্রুপ যুগ্ম সম্পাদক, আমাদের নতুন সময়