খোন্দকার আতাউল হক : কিছু দিন আগেও বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির যে দুর্দশা বিরাজ করছিল, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর সেই পরিস্থিতির আংশিক উন্নতি হয়েছে। তবে নির্বাচনকে ঘিরে যে শঙ্কা, সংশয় সেটা কিন্তু একেবারে নিবৃত্ত হয়নি। পরস্পর পরস্পরের প্রতি পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তো আছেই। এমন অবস্থা দেখে আমার মনে পরছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন লন্ডনের আকাশে জার্মান বোমারু বিমান অনবরত উড়ছিল তখন চার্চিল বলেছিলেন, ‘অষড়হব রহ ঃযব নবধপয’, অর্থাৎ ‘সমুদ্র সৈকতে তিনি একা’। আমাদের দেশের আকাশে কোনো ভিনদেশি বোমারু বিমান না উড়লেও গণতন্ত্রের খাদকরা বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন রূপে উড়ছে বলে রাজনীতিক বিশেষজ্ঞদের মন্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে। সামনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। রাজনৈতিক জোট এবং দলসমূহ নামমাত্র গণতন্ত্রের স্লোগান ব্যবহার করে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে নেমেছে। এখানে জাতীয় সমস্যা, জনগণের প্রাপ্য মৌলিক অধিকার, জীবিকা নির্বাহের কর্মসংস্থানের কোনো দফা তাদের মুখে নেই। আছে শুধু ক্ষমতা দখলের রাজনৈতিক রণকৌশল। এই ক্ষমতা দখলের নির্বাচনে যে দল বা জোট ক্ষমতার কেদারা দখল করবেন তিনি জাতিকে কতটুকু শস্তি, শান্তি এবং জীবিকা নির্বাহের সরল সহজ পথ দেখাতে পারবেন তা নিয়ে জনমনে যথেষ্ট আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন গণতান্ত্রিক নাগরিকগণ।
আমরা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে যদি নীবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করি তবে দেখতে পাব, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বর্তমান রাজনীতি তিনটি ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। রাজনীতিকদের ভাষায় তিনটি ধারার মধ্যে প্রথমত: সরকার এবং সরকারি দল সমর্থিত মহাজোট। দ্বিতীয়ত: বিএনপি সমর্থিত জাতীয় ঐক্যজোট। তৃতীয়ত: বাম গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট।
এখানে উল্লেখ্য সরকার এবং সরকারি দল সমর্থিত মহাজোট নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দিতে উন্নয়ন ও গণতন্ত্রকে সহাবস্থানে রেখে প্রচারাভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।। দ্বিতীয় বিএনপি সমর্থিত জাতীয় ঐক্যজোট এবং তৃতীয় বাম গণতান্ত্রিক জোটসমূহ নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে মাঠে অবস্থান করছে। তবে উভয় জোটের নেতাদের দম্ভোক্তিতে মনে হয় না যে এখন দেশে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র বিরাজমান। গণতন্ত্র এখন খাদকদের খপ্পরে। এমন অবস্থায় দেশবাসী কারো পক্ষাবলম্বন না করে নীরব দর্শকের ভূমিকায় এখনো স্থিতি অবস্থায় রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্বাচন কেন্দ্রিক এই তিনটি ধারার মধ্যে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমন্বয় যদি না ঘটে; তাহলে সমুদ্রের পানি ঘোলা হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। আর সমুদ্রের পানি যদি ঘোলা হয়ে যায় তবে কি জানি কে কখন চার্চিলের মতো বলে উঠবে, ‘অষড়হব রহ ঃযব নবধপয’! ‘সমুদ্র সৈকতে তিনি একা’।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বড় সুখকর নয়। বিগত ৪৭ বছরের ইতিহাস তাই বলে। দেশে একটি পরিচ্ছন্ন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে বারবার ইতিহাসের পাতা রক্তাক্ত হয়েছে। কখনো নীল আকাশের মতো অথবা প্রকৃতির সবুজ অরণ্যের বর্ণ ধারণ করতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, গণতন্ত্রকে নিয়েই রাজনীতি। গণতন্ত্র এবং রাজনীতি একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু সেই গণতন্ত্র এবং রাজনীতি রাষ্ট্র ও জাতি কেন্দ্রিক না হয়ে, হয়ে যায় ক্ষমতা কেন্দ্রিক। ফলে গণতন্ত্রের ভাষায় আর গণতন্ত্র চর্চা হয় না। গণতন্ত্র একটি নিরন্তর আন্দোলন। গণতন্ত্রের মূলমন্ত্রই হচ্ছে মুক্তজ্ঞান চর্চা, মুক্তবুদ্ধি চর্চা, মুক্ত আলোচনা, ধৈর্যশীল আচরণ এবং নিজ ভাষা প্রকাশের পাশাপাশি অন্যের ভাষা প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা। এখানে সেই পরিবেশ ও সুযোগের ঘাটতি আছে। অর্থাৎ আমরা কেউই গণতন্ত্রের আদর্শিক চর্চা করছি না।
এসব কারণে জনগণ ব্যবহারিক জীবনে গণতন্ত্র চর্চা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গণতন্ত্র এবং শাসনব্যবস্থা এখন ব্যক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে। এই দৃশ্য সরকার, সরকারি দল এবং বিরোধী দলের মধ্যে প্রথাগতভাবে শিকড় গেড়ে বসেছে। যার কারণে গণতন্ত্র এখন দুইটি বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে কুক্ষিগত হয়েছে। এই দু’টি বড় রাজনৈতিক দল নিজেরাই উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে গণতন্ত্রকে দু’টি শিবিরে বিভক্ত করে ফেলেছে। সে কারণে দু’টি বড় রাজনৈতিক দলের সমর্থক গোষ্ঠির দ্বারা জনগণকেও দু’টি শিবিরে বিভক্ত করা হয়েছে। আমাদের দেশের মতো গণতন্ত্রের এমন বেহাল দশা বোধকরি বিশ্বের উন্নয়নশীল এবং উন্নত দেশগুলোতে নেই। দেশে জনকল্যাণবান্ধব রাজনৈতিক দল না থাকার কারণেই আমাদের রাজনীতি এখন লর্ড ক্লাইভ স্টাইলে পরিণত হয়েছে।
এখন গণতন্ত্র, রাজনীতি এবং শাসনব্যবস্থার কোথাও সুবচন, সুশাসন, সুরক্ষা এবং সু-আচরণ নেই। গণতন্ত্র এখন একক নেতৃত্ব, কর্তৃত্ববাদী দু’টি বড় রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে বন্দি। এসব আচরণের কারণে জনগণ এখন এই দু’টি বড় রাজনৈতিক দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারতো যদি প্রতিশ্রুতিশীল কোনো রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটতো। কিন্তু সেই সম্ভাবনা নেই। বড় দু’টি রাজনৈতিক দল সে উদ্যোগ অঙ্কুরেই বিনাশ করে দেবে। ক্ষমাতার নাগর দোলায় কেবল দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের আস্ফালনই জনগণ দেখতে পায়। আর সেই নাগর দোলায় চড়ে এবার ক্ষমতায় কে যাবে তা নির্ধারণ করবে দেশবাসী তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে। তখন জনগণ দেখবে নির্বাচনের দিন কে কখন বলবে, ‘অষড়হব রহ ঃযব নবধপয’! ‘সমুদ্র সৈকতে তিনি একা’।
এই নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন না ঘটলেও দু’টি বড় রাজনৈতিক দলের ইচ্ছা পূরণ হবে। নির্বাচন কেন্দ্রিক বিদ্যমান তিনটি ধারা যেখানে যে অবস্থায় ছিল সেখানে সেই অবস্থায়ই থেকে যাবে। দু’টি রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা কেন্দ্রিক নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের মাধ্যমে কারো ভাগ্য সৌভাগ্যের বর বয়ে আনলেও জনগণের ভাগ্যাকাশে শুধুই ‘ডু’ লেখা ছাড়া অন্য কোনো পরিবর্তন আসবে না। নির্বাচনে জয়ী হয়ে নেতা পাবে ‘বর’ জনগণ দেবে কর, তাই তো? সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের বিষয় হলো মানুষের প্রতি সৃষ্টিকর্তা বা ভগবান সদয় থাকলেও মানুষরূপী ভগবানরা কেন জনগণের প্রতি নির্দয়? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে চার্চিলের ভাষায় নির্বাচন শেষে কাউকে না কাউকে বলতে হবে, ‘অষড়হব রহ ঃযব নবধপয’! ‘সমুদ্র সৈকতে তিনি একা’। এটাই হবে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা বঞ্চিত ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলের শেষ পরিণতি। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সম্পাদনা : নুসরাত শরমীন