অসীম সাহা : রণেশ দাশগুপ্ত। সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংগ্রামী, রাজনৈতিক কর্মী ও দেশের স্মরণীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের নাম রণেশ দাশগুপ্ত ।
জন্ম ১৫ জানুয়ারি ১৯১২। শৈশবের অনেকগুলো দিন বাংলার মাটিতে কাটলেও ১৯২৯ সালে বিহারের রাঁচির একটি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে বাঁকুড়া কলেজে ভর্তি হন। এ-সময় অনুশীলন দলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘটে ও তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বাঁকুড়া কলেজ থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হলে তিনি কলকাতায় এসে সিটি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু পুলিশি তৎপরতায় লেখাপড়া বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় বরিশালে এসে ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩৪ সালে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের গাউরদিয়া গ্রামে পৈতৃক বাড়িতে সকলে মিলে বসবাস করতে শুরু করেন। পরে ওই গ্রাম পদ্মায় বিলীন হয়ে গেলে স্থায়ীভাবে ঢাকা শহরে চলে আসেন। যুক্ত হন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। তরুণ সাহিত্যিক সোমেন চন্দ, অচ্যুত গোস্বামী ও কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত প্রমুখের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে নিয়োজিত হন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর রাজনৈতিক কারণে তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। গোটা পাকিস্তানি আমলে তিনি বহুবার কারাবাস করেছেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময়ে তিনি কারাগারে ছিলেন এবং সেখানেই তিনি নাট্যকার মুনীর চৌধুরীকে ‘কবর’ নাটক লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। কারামুক্তির পর ১৯৫৫ সালে তিনি ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। এ-সময়েই তিনি সাহিত্যিক খ্যাতি লাভ করতে থাকেন। ‘উপন্যাসের শিল্পরূপ’ (১৯৫৯) নামে তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশিত হবার পর সুধীমহলে তিনি সুপরিচিত হয়ে ওঠেন।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী পালনের সময় তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬২ সালে ছাড়া পান। ফের ১৯৬৫ সালে কারারুদ্ধ হন। ছাড়া পান ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময়। ১৯৬৯ সালে বিপ্লবী সত্যেন সেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, কামরুল আহসান খান প্রমুখ একঝাঁক তরুণকে নিয়ে ‘উদীচী’ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি আমাদের গৌরবোজ্জল মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে এসে নিজেকে শ্রমজীবী মানুষের সেবায় উৎসর্গ করেন।
এমন একজন নির্মোহ বিপ্লবী মানুষ রণেশদার সঙ্গে আমার দেখা হয় ১৯৬৭ সালে। ২৬৩ বংশাল রোডে অবস্থিত দৈনিক সংবাদ পত্রিকার দোতলায় পশ্চিমদিকের একটি রুমে বসতেন কথাসাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সারের পাশের একটি চেয়ারে। ধ্যানমৌন ঋষির মতো অবয়ব। শাদা-পাকা দাড়ি। হাঁটু পর্যন্ত ফুলশার্ট, পরনে শাদা পায়জামা, পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। কিন্তু মুখের মধ্যে অদ্ভুত এক গাম্ভীর্য, যা তাঁর মুখ থেকে কখনো পিছলে পড়ে যেতো না! তাই তাকে দেখে একটা ভীতসন্ত্রস্ত অনুভূতি কাজ করতো বলে কাছে গিয়ে কথা বলার সাহস পাইনি। কিন্তু এরপর ১৯৬৯ সালে যখন আমি স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসি, তখন ধীরে ধীরে রণেশদার সঙ্গে একটা নিবিড় সখ্যের বন্ধন জড়িয়ে পড়ি। সংবাদের খেলাঘরের আসরকে কেন্দ্র করে আমরা অনেকেই সংবাদ অফিসের দোতলায় উত্তরদিকের একটি ঘরে নিয়মিত আসতাম। সেই সূত্রে এবং কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফার সম্পাদনায় ‘মাসিক স্বদেশ’ নামে সাহিত্য-সংস্কৃতির একটি পত্রিকা প্রকাশিত হলে সেখানে আামি সম্পাদনা সহযোগী হিশেবে কাজ শুরু করি। সেই সুবাদে লেখা সংগ্রহের জন্য একদিন রণেশদার লক্ষ্মীবাজারের বাসায় যাই। গিয়ে দরোজায় নক করতেই লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরিহিত রণেশদা এসে দরোজা খুলে দেন। ঘরে ঢুকে দেখি অতি সাধারণ একটি রুম। স্যাঁতসেঁতে। সেখানে মেঝেতে একটি বিছানা পাতা। তার ওপর কাঠের একটি ‘গদিবাক্স’, যার ওপর কাগজ রেখে লেখালেখি করেন তিনি। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। একজন কমিউনিস্টের জীবন কেমন হতে পারে, তা স্বচক্ষে দেখে আসি। এরপর থেকে রণেশদার সঙ্গে ধীরে ধীরে আমার আরো নিবিড় সখ্য গড়ে ওঠে। আমি তাঁর স্নেহচ্ছায়ার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হতে থাকি। এরপর অরো কতোশতবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। আপাতগাম্ভীর্যের আড়ালে তাঁর ব্যক্তিত্বপর্ণ অবয়ব বারবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সারাজীবন অকৃতদার এই মানুষটি মানুষের জন্যে, পার্টির জন্যে সবকিছু অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে গেছেন। কিন্তু বিনিময়ে আমরা তাঁকে কী দিয়েছি? দেশ থেকে নির্বাসন! ১৯৭৫ সালের ১ নভেম্বর সেই যে ভারতে চলে গিয়েছিলেন, আর ফিরে আসেননি। কেন, কিসের অভিমানে? আমরাও তাঁকে ফিরয়ে আনার চেষ্টা করিনি! কেন করিনি? কমিউনিস্ট পার্টির কারো কি মনে হয়নি, তাঁর মতো ত্যাগী একজন কমিউনিস্ট নেতাকে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা? জেনেছি, কোলকাতার একটি জীর্ণ ঘরে তিনি একাকী তাঁর শেষজীবন কাটিয়েছেন। সে জীবন ছিলো দুর্বিষহ। তবু তাঁকে ফিরিয়ে আনতে চাইনি আমরা কেউ। হ্যাঁ ফিরিয়ে এনেছি। ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর তিনি যখন ‘জীবন-মরণের সীমানা ছাড়ায়ে’ চলে গেছেন, তাঁর সেই নিথর দেহকে তাঁর প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে এনেছি। তাঁর শবদেহে ফুল ছড়িয়েছি। আপাদমস্তক সৎ, ত্যাগী, জ্ঞানী ও নির্মোহ মানুষটিকে জীবিত থাকতে যে সম্মান তাঁর প্রাপ্য ছিলো, জীবনে আমরা তার মূল্য না দিতে পারলেও অন্তত মৃত্যুর পরে তো দিয়েছি! এটাই বোধহয় একজন সৎ ও ত্যাগী মানুষেরর জীবনের শেষপ্রাপ্য। প্রয়াণদিবসে তাঁর স্মৃতির প্রতি সশ্রদ্ধ অভিবাদন।
লেখক : কবি ও সংযুক্ত সম্পাদক, আমাদের নতুন সময়