দাউদ হায়দার : আমাদের দেশী লোক অসহায় দেশী মেয়ে পেলেই তাঁকে অপমান করবে- অত্যাচার করবে আর এটিই দেশের নিয়ম’। লিখেছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসে। ১০৬ বছর আগে (যদিও ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে পুরস্কারে প্রথম প্রকাশিত।) যে লোক চরিত্রহীন, মূলত সেই বলতে পারে কে চরিত্রহীন। সোজা কথা, চরিত্রহীন ছাড়া চরিত্রহীনকে চিনবে কে? চোরকে যেমন চোর চেনে, সাধুকে যেমন সাধু। এস.ওয়াজেদ আলি শত বছর আগেই জানিয়েছিলেন, ‘সেই ট্রাডিশন সমানে চলিতেছে’। মিথ্যে বলেননি। যেমন বলেছেন শরৎচন্দ্র।
‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এ বঙ্কিমচন্দ্র, ‘হ-য-ব-র-ল’এ সুকুমার রায় উকিল (আজকের দিনে হয়তো ব্যারিস্টার) কী জিনিস, কী চরিত্রের ‘জীব’ আমাদের জানিয়েছেন। সততার বদলে অসততাই যার (বা যাদের) মূলধন। ধরা যাক, কাউকে পছন্দ করি না, তাঁর কথা অপছন্দ, তাঁর চালচলন অপছন্দ, তাঁর চাহনি, ভ্রুভঙ্গি, কেশ, পোশাক অপছন্দ, তাঁকে কি বলবো চরিত্রহীন? কী সংজ্ঞা চরিত্রহীনের? ইংরেজিতে Morally Corrupted wKsev Libertine বললে আমরা বুঝি মনমানসিকতায় অসৎ, হাড়েমজ্জার ‘বদমাইশ’।
‘ক্যারেক্টারলেস’ কাকে বলে যার চরিত্র নেই, চরিত্রহীন? কেউ একজন ফতোয়া দিলেই চরিত্রহীন হয়ে যায়? শ্রীকৃষ্ণের ১৬ হাজার গোপিনী ছিলেন, রাধার সঙ্গে লীলা করেছেন (রাধার স্বামী ছিলেন আয়ান ঘোষ)। রাধাকৃষ্ণের প্রেম নিয়ে দুজনকে চরিত্রহীন বলুন একবার, হিন্দুরা ক্ষিপ্ত হবেন ব্ল্যাসফেমি জারি করবেন, পেঁদিয়ে আপনাকে বৃন্দাবনে পাঠাবেন। কৃষ্ণ, রাধা প্রেম করেছেন, লীলা করেছেন তাই বলে কি চরিত্রহীন? প্রিন্সেস ডায়ানার সঙ্গে প্রিন্স চার্লসের বনিবনা হচ্ছে না, ডায়ানা একজন বা অনেককে পছন্দ করছেন, একত্রে থাকছেন, ভ্রমণ করছেন (দোদির সঙ্গে), প্রিন্স চার্লস বিবাহিত হয়েও (ডায়ানা তাঁর নেই) ক্যামিলার সঙ্গে যথারীতি সম্পর্কিত, সাহস আছে কি বলার ডায়ানা-চার্লস চরিত্রহীন? অভিনেত্রী এলিজাবেথ (লিজ) টেলর সাতবার বিয়ে করেছেন।
এক স্বামীকেই (রিচার্ড বার্টন) দু’বার। লিজ টেলর চরিত্রহীন হয়ে গেছেন? স্বামী প্রেমিকের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি, বিচ্ছেদ হতেই পারে। হওয়া স্বাভাবিক, যদি না মনপ্রাণে এক হন। স্বামী বা স্ত্রীর বিচ্ছেদের পড়ে অন্য একজনকে (স্বামী বা স্ত্রীর) ভালো লাগতেই পারে। তাঁর সঙ্গে একাত্ম হতেই পারে, হচ্ছেও পৃথিবীর নানাদেশের রাষ্ট্রসমাজে, ধর্মও বাধা নয়, সমাজও নয় (দেখেছি মিশরে, মরক্কোয়, তিউনেশিয়ায়)।
নারী স্বাধীনতার যুগে একজন নারীকে চরিত্রহীন কেন বলছেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন? বলছেন এই কারণেই, নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নন। নারীর চরিত্র তাঁর কাছে নারীর ‘চরিত্রহীনতা’। তাঁর কাছে নারীর স্বাধীনতা নেই। নারীর কোনও ইচ্ছে অনিচ্ছে- প্রম-সাধ আহ্লাদ-কামনাবাসনা নেই। তাঁর কাছে নারীমাত্রই চরিত্রহীন। তাই যদি না হবে মাসুদা ভাট্টিকে কেন চরিত্রহীন বলবেন? মাসুদা ভাট্টি নারীর স্বাধীনতা, অধিকারে বিশ্বাসী বলে? মাসুদা ভাট্টির জীবনাচার, স্বাধীন চেতনায় যে উদ্দীপনা, মহিমা, নিশ্চয় নারী স্বাধীনতার মৌলিক সোপান। বিশ্বজুরে এখন ‘মি টু’ জোরদার। নারীর গায়ে হাত দেওয়া, কামচোখে দেখা (ইত্যাদি) ‘মি টু’র আওতায়। নারীকে চরিত্রহীন বলাও ‘মি টু’।
অর্থাৎ ‘চরিত্রহীন’ বলায় যৌনতার প্রকাশ। মাসুদা ভাট্টি যদি মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে ‘মি টু’র মামলা ঠোকেন, সাধুবাদ সব মহল থেকে। মইনুল হোসেনের চেয়ে মাসুদা ভাট্টি শতগুণে পন্ডিত। তাঁর লেখাপড়া, বোধবুদ্ধি, বিচারবিশ্লেষণ ঈর্ষণীয়। পাঁচটি ভাষায় দক্ষ। চাট্টিখানি কথা নয়। বিশ্বের নানা দেশের শিল্পসাহিত্য-সংস্কৃতিধর্ম তাঁর করায়ত্ত।
তিনি রাজনৈতিক, দার্শনিক চিন্তাভাবনায় সর্বদাই সমকালীন। তাঁর ভাষ্য সহজে উড়িয়ে দেবার নয়। মইনুল হোসেন, মইনুল হোসেনরা আজ আছেন কাল নেই। কিন্তু মাসুদা ভাট্টির গল্প কবিতা উপন্যাস, প্রবন্ধ, পরম পাওনা। এমন কী তাঁর রাজনৈতিক লেখা। মইনুল হোসেন তাঁর মৃত্যুর পরেই বিলীন, লাপাত্তা। একজনও মনে রাখবে না। মাসুদা ভাট্টি মারা গেলেও সাধারণ মানুষ স্মরণ করবে দীর্ঘকাল, বলবে, ‘হ্যাঁ, ছিলেন বটে, নির্ভয়ে প্রশ্ন করতে পারতেন রাজনীতিকের চরিত্রের স্খলন’।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক