ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ : গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সরকার পরিবর্তনের সর্বোত্তম মাধ্যম হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের পছন্দমতো লোকদেরকে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে পারে। উন্নত দেশগুলোতে নির্বাচনে কোনোপ্রকার কারচুপি হয় না বলে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হওয়ায় গণতন্ত্রের ভীত খুবই দুর্বল। ফলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিদ্যমান। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দানের জন্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন একান্ত প্রয়োজন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। নির্বাচন কমিশন যদি শক্তিশালী ও দায়িত্বশীল না হয় তবে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভাব নয়। কেননা নির্বাচন পরিচালনার সকল দায়িত্বই নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত। ভোটার তালিকা প্রণয়ন, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা, নির্বাচনি আচরণবিধি প্রণয়ন এবং নির্বাচনি পরিবেশ পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত। সুতরাং শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন ব্যতিত অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দলের সম্মতিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদেরকে নিয়োগ দান করা প্রয়োজন।
নির্বাচন কমিশন গঠনের সময় রাষ্ট্রপতি সরকার ও বিরোধ দল বিশেষত সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলার সাথে আলোচনা করে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হবে। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নির্বাচনের জন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচন কশিনের স্থায়ী রিটার্নিং ও সহকারি রিটানিং অফিসার নিয়োগের সুপারিশ করেছে। প্রচলিত ব্যবস্থায় জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ফলে তারা কোন কোন ভাবে রাজনৈতিক দল দ্বারা প্রভাবিত হন, যা সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা হিসেবে কাজ করে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীরা নির্বাচনে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে। ফলে কালো টাকার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে যদি প্রার্থীদের নির্বাচন বাবদ যে টাকার খরচ হয় তা পুরোটাই কমিশনের মাধ্যমে ব্যয় হলে অপচয় রোধ হবে। তাছাড়া প্রার্থীরা কমিশনের মাধ্যমে লিফলেট, সভা-সমিতি, পোস্টার ও প্রচারকার্য চালালে একদিকে খরচ কম হবে। অন্যদিকে নির্বাচনও সুষ্ঠু ও অবাধ হবে।
নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য আধা বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করার আইনগত অধিকার প্রদান করা যেতে পারে। এ ব্যবস্থার ফলে নির্বাচন কমিশন দ্রুত নির্বাচনি মামলার নিষ্পত্তি করতে পারবে। জাতীয় নির্বাচন ১ দিনে না করে কয়েক দিনে করলে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হতে পারে। একদিনে নির্বাচন করতে গেলে জনবল ও পুলিশ প্রয়োজনের তুলনায় কম। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা কষ্টকর হয়ে পড়ে যা নির্বাচনে পেশীশক্তির প্রভাব বিস্তারে সহায়ক হয়। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন কয়েক দিনে সম্পন্ন হলে জনবল ও পুলিশ বাহিনী বিভিন্ন অঞ্চলে দায়িত্ব পালণ করতে পারে যা নির্বাচন সুষ্ঠু হতে সহায়ক হবে।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকার একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করবেন এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিগণের সাহায্য ও সহায়তায়, উত্তমরূপে সরকারের দৈনন্দিন কার্যাবলী সম্পাদন করবেন এবং এরূপ কার্যাবলী ব্যতিত কোনো নীতি-নির্ধারণী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারবেন না। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকার এমন ব্যবস্থা নেবেন যেন দেশের রাজনৈতিক অবস্থা অস্থিতিশীল না হয়। এছাড়া নির্বাচনকালে রাজনৈতিক দলগুলো যাতে কোনো ঘটনা না ঘটায় সেদিকে নজর রাখতে সচেষ্ট হবেন। জনগণ যাতে সুষ্ঠুভাবে তাদের ভোট দিতে পারে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকার সেদিকে খেয়াল রাখা আবশ্যক। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো যাতে ব্যাপক প্রচার অভিযান করতে না পারে যেমন দেওয়াল লিখন, বড় বড় পোস্টার ছাপানো ইত্যাদি ব্যাপারে নিয়ন্ত্রিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকার।
এসব বিষয়গুলো নির্বাচনের অঙ্গ কিন্তু এগুলো যেন সীমালঙ্ঘন না করে সেদিকে ব্যবস্থা নিবে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকার। নির্বাচনে আমাদের দেশে সন্ত্রাসী তৎপরতা চলে, এজন্য অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়। নির্বাচনে যাতে কেউ অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করতে না পারে, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে ভোট ছিনতাই করতে না পারে সে ব্যাপারে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। রাজনীতিতে কোনো অবস্থাতেই দল নিরপেক্ষ ব্যক্তি পাওয়া যাবে না। তবে দলসমূহে বা দলের বাইরে সৎ, সাহসী, নীতিবান, দক্ষ ও চৌকষ ব্যক্তিদের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে। যারা ভোট কারচুপি নির্বাচনি আইন ভঙ্গকারীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবেন না। নির্বাচনে আইন সংস্কার প্রশ্নে যেমন ভোটিং কার্ড প্রবর্তন, ভোট গণনায় স্বচ্ছতা, নির্বাচনি ব্যয়, নির্বাচনি প্রচার ইত্যাদি বিষয়গুলোতে সংস্কার এনে নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করা সম্ভব। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন করা যেমন নির্বাহী বিভাগের উপর নির্ভরশীলতা কমোনোর ব্যবস্থাকরণ, জুডিশিয়াল বা আধা জুডিশিয়াল ক্ষমতা অর্পণ করে বিশেষ বিতর্কিত বা অভিযোগপ্রাপ্ত বিষয়ে সমাধানের পথ সুগম করার ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক। প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীদের নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের ব্যাপারে নির্বাচনি আইন ঢেলে সাজানো আজ সময়ের দাবি।
নির্বাচন পরিচালনার কাজে কোনো স্থানীয় লোকের নিযুক্ত পরিহার বাঞ্ছনীয়। শুধুমাত্র মনোনীত প্রার্থীর এজেন্ট স্থানীয় লোক হবেন, তাও যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও স্থানীয় পুলিশ যাচাইকরণ ও ছাড়করণের ভিত্তিতে। এতসব সত্ত্বেও সবকিছুর উর্ধ্বে হচ্ছে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা এবং তার আন্তরিকতার মাধ্যমে দেশ যেকোনো সঙ্কট বা ক্লান্তিকাল অতিক্রম করতে পারে। তার অভিজ্ঞতালব্দ জ্ঞান ও দূরদর্শিতায় এবং প্রবর্তিত ফর্মুলার মাধ্যমে সকল সমাধান সম্ভব। কাজেই জাতি কোনো সঙ্কট বা অতঙ্কগ্রস্ত হবে এরকম দুর্ভনার কোনো অবকাশ নেই।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
forqan.info@gmail.com