হুমায়ুন কবির খোকন: ‘জয় বাংলা স্লোগান নিয়ে’ মহাকাশের পথে পাড়ি জমাল বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। আজ শুক্রবার (১১ মে) বাংলাদেশ সময় দিবাগত রাত ২টা ১৪মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোর কেপ কেনেডি সেন্টারের লঞ্চিং প্যাড থেকে মহাকাশের পথে উড়াল দেয় বঙ্গবন্ধু-১।
এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের দিয়ে অবস্মরণীয় এক অর্জন হলো বাংলাদেশের। বহু আগেই বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলের স্বীকৃতি পেয়েছে। এবার মহাকাশেও লাল সবুজের গৌরবগাঁথা দেখল বিশ্ব। ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠালো বাংলাদেশ।
এর আগে বাংলাদেশ সময় গত বৃহস্পতিবার রাত ১টা ৩৭ মিনিটে দেশের প্রথম এ যোগাযোগ উপগ্রহ যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে অরবিটাল স্লটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরুর কথা ছিল। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে (স্ট্যান্ডার্ড গ্রাউন্ড সিস্টেম অটো অ্যাবোর্ট) এটির উৎক্ষেপণ স্থগিত করা হয়।
স্পেসএক্স শুক্রবার এক টুইটার বার্তায় জানিয়েছে, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে (স্ট্যান্ডার্ড গ্রাউন্ড সিস্টেম অটো অ্যাবোর্ট) শুক্রবার উপগ্রহটি উৎক্ষেপণ স্থল থেকে নামানো হয়েছে। রকেট ও স্যাটেলাইট সম্পূর্ণ অক্ষত রয়েছে এবং এটি উৎক্ষেপণে নিয়োজিত দল যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বিকেল ৪ টা ১৪ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় শুক্রবার দিবাগত রাত ২ টা ১৪ মিনিট) উপগ্রহটি আবারো উৎক্ষেপণে কাজ করে যাচ্ছে। স্পেসএক্স দেশের প্রথম জিওস্টেশনারি কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটটি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে কক্ষপথে পাঠাতে শুক্রবার দিবাগত রাতে আবারো উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়া শুরু করার কথা রয়েছে। স্পেসএক্সের ফ্যালকন-৯ রকেটে করে কেপ ক্যানাভেরাল উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে এ স্যাটেলাইটটি মহাকাশে যাত্রা করবে। দেশের সব বয়সের মানুষ সরাসরি সম্প্রচার করা এ উৎক্ষেপণ অনুষ্ঠান দেখার জন্য মধ্য রাতের পরও জেগেছিল। শুধু তাই নয় বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরাও সরাসরি সম্প্রচারিত এ উৎক্ষেপণ অনুষ্ঠান গভীর আগ্রহের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করতে জেগে ছিল। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে প্রেরণের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ যোগাযোগ উপগ্রহ উৎক্ষেপণকারী ৫৭তম দেশে পরিণত হবে।
তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, উৎক্ষেপণের ঠিক দুই মিনিট আগে এটি কম্পিউটারের কন্ট্রোলে চলে যায়। হয়ত কিছু সমস্যায় আপতত উৎক্ষেপণ স্থগিত করা হয়েছে। ঠিক একই সময়ে শুক্রবার দিবাগত রাতে পুনরায় উৎক্ষেপণের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে উপস্থিত তারানা হালিমও বলেন, শুক্রবার একই সময়ে উৎক্ষেপণের ক্ষণ নির্ধারণ করা হয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলেছে, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণটি ২৪ ঘণ্টার মতো পিছিয়ে যাচ্ছে। কী সমস্যা দেখা দিয়েছে, তা চিহ্নিত করা যায়নি। কেনেডি স্পেস সেন্টারে থাকা বিটিআরসি প্রধান শাহজাহান মাহমুদও বলেন, বহু ঘটনা আছে, যেখানে কাউন্ট ডাউনের একেবারে শেষ পর্যায়ে গিয়েও উৎক্ষেপণ স্থগিত করতে হয়েছে। ফরাসি প্রতিষ্ঠান তালিস এলিনিয়া স্পেসের তৈরি বাংলাদেশের জাতির জনকের নামাঙ্কিত এই স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্সের মাধ্যমে।
স্পেসএক্স তাদের ওয়েবসাইটে জানিয়েছে, শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১৪ থেকে ৪টা ২১ মিনিটের মধ্যে উৎক্ষেপণের নতুন সময় ঠিক করা হয়েছে। কেনেডি স্পেস সেন্টারের লঞ্চ প্যাড ৩৯ এ থেকে এটি উৎক্ষেপণ হচ্ছে, এই প্যাড থেকেই মানুষকে নিয়ে চাঁদে রওনা হয়েছিল চন্দ্রযান অ্যাপোলো-১১।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মহাকাশে পৌঁছার পর বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে লাগবে প্রায় এক মাস। এরপর কারিগরি বিভিন্ন বিষয় শেষ করে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে আসতে আরও এক মাস সময় লাগবে বলে ধারণা বিটিআরসির। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের জন্য গাজীপুরের জয়দেবপুরে এবং রাঙামাটির বেতবুনিয়ায় নির্মিত হয়েছে গ্রাউন্ড স্টেশন। স্যাটেলাইট মহাকাশে উন্মুক্ত হওয়ার পর প্রাথমিকভাবে নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি এবং কোরিয়ার তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশনে চলে যাবে।
প্রকল্প পরিচালক মো. মেজবাহুজ্জামান বলেছেন, এই তিন স্টেশন থেকে স্যাটেলাইটটিকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এর নিজস্ব কক্ষপথে (১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অরবিটাল স্লট) স্থাপন করা হবে। স্যাটেলাইটটি সম্পূর্ণ চালু হওয়ার পর এর নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের গ্রাউন্ড স্টেশনে হস্তান্তর হতে আরও এক মাস সময় লেগে যাবে। বাংলাদেশ এতদিন বিদেশি স্যাটেলাইট ভাড়া করে সম্প্রচার ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়ে গবেষণার কাজ চালিয়ে আসছিল; বর্তমানে বিদেশি স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ বাংলাদেশকে গুণতে হয় ১ কোটি ৪০ লাখ ডলার। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে, যার ২০টি বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য রাখা হবে এবং বাকিগুলো ভাড়া দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে নেপাল, মিয়ানমার ও ভুটানের কাছে স্যাটেলাইট সেবা দিয়ে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা আয়ের সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খলিলুর রহমান বলেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের অবস্থান হবে ইন্দোনেশিয়ার একদম উপরে। ইন্দোনেশিয়ার পেছন দিকে পুরোটাই সমুদ্র। ইন্দোনেশিয়া থেকে সামনের দিকে যত দেশ আছে যেমন মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর সবই কিন্তু আমাদের কাভারেজে আছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে চাকরির নতুন ক্ষেত্র ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে বলেও মনে করেন এই শিক্ষক।
নিজস্ব এই স্যাটেলাইট বাংলাদেশে ডিজিটাল বৈষম্য দূর করতে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছে সরকার। ডাইরেক্ট টু হোম (ডিটিএইচ) পদ্ধতিতে স্যাটেলাইট থেকে সিগনাল গ্রহণের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলেও সরাসরি টেলিভিশন সম্প্রচার করা সম্ভব হবে। বিশেষ করে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশের বিদ্যমান টেরেস্ট্রিয়াল অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও যোগাযোগব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন রাখতে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ব্যবহার করা যাবে। ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ফিরোজ আহমেদ বলেন,সাবমেরিন কেবল সি-মি-উই ৪ এবং সি-মি-উই ৫ যদি কোনো কারণে কাজ না করে তখন বিকল্প যোগাযোগে এই স্যাটেলাইট কাজে আসবে।
কৃষি, বন, মৎস্য, ভূতত্ত্ব, মানচিত্র তৈরি, পানি সম্পদ, ভূমি ব্যবহার, আবহাওয়া, পরিবেশ, ভূগোল, সমুদ্র, বিজ্ঞান, শিক্ষা এবং জ্ঞান ও বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রে মহাকাশ ও দূর অনুধাবন প্রযুক্তিকে ব্যাবহার করা এবং প্রযুক্তির উন্নয়ন ও ব্যবহারিক প্রয়োগের জন্য গবেষণায়ও তথ্য-উপাত্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এই স্যাটেলাইটের সহায়তা পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। সরকার বড় আশা করলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা পুরোটাই নির্ভর করবে ব্যবসার কৌশলের উপর। এর মাঝে স্যাটেলাইটের সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য ‘বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড’ নামে একটি সংস্থা গঠন করা হয়।