বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন যে স্বাধীনতা, সেই মুক্তিসংগ্রামের বিস্ফোরণের শুরুটা ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমার প্রতিটি সংগ্রাম প্রতিটি আন্দোলন, অশুভ আর অসত্যের বিরুদ্ধে যে প্রতিটি প্রতিবাদ, তার সবখানেতে সাহস জোগায় আমার একুশ। সেই শহীদ দিবস আজ মায়ের মুখের ভাষার প্রতি পরম ভালোবাসায় আর সগৌরবে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার মন্ত্রণা হয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে সারাবিশ্বে। এর মূল শক্তি তো শোকের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে।
অথচ সেই আমরা একুশের গুরুত্ব, ভাব গাম্ভীর্য ভুলে গিয়ে পুরো বিষয়টাকে উৎসব বানিয়ে ফেলছি। শুধুই কি জুতা পায়ে প্রভাত ফেরী? একুশ এখন পুঁজিওয়ালাদের ব্যবসার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো একুশের চেতনাকে পুঁজি করে বড় বড় বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণ করে লুটে নেয় গরিবের টাকা। নামিদামি থেকে শুরু করে আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকাগুলোতে ‘একুশের সাজ’ শিরোনামে প্রকাশ হয় বিশেষ বিশেষ আয়োজন। সেখানে একুশের গয়না, একুশের শাড়ি, একুশের পাঞ্জাবি আরও কত কি বাহারি আয়োজনের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করা হয়!
কোনো কোনো পত্রিকায় একুশ উপলক্ষে বিশেষ খাবার দাবারের বর্ণনাও তুলে ধরা হয় নির্লজ্জভাবে। ছাপা হয় ‘একুশের কেক’এর ছবি। এখন ২১ ফেব্রুয়ারির দিনে সপরিবারে অনেককে দেখি বর্ণিল সাজে পার্কে, রেস্তোরায় ধুমধাম আয়োজনে। এ যেন আনন্দ-হাসি-ঠাট্টায় মেতে ওঠার একটা বিশেষ দিন। সেই মুহূর্তে শহীদ মিনারে ফুল হাতে আসা মানুষের উপচেপড়া ভিড়কে সত্যিই মনে হয় যেন কেবলই লৌকিকতা, হাত থেকে হাতে সেলফি তুলবার প্রতিযোগিতা।
পুঁজিবাদের ঢেউয়ে হারিয়ে যাচ্ছে আমার আবেগ, পুঁজিবাদের আছড়ে পড়া ¯্রােতে ক্ষত-বিক্ষত আমার চেতনা, পুঁজির জোয়ারে পথ ভুলে যায় আমার অস্তিত্ব। তবে শহীদের রক্তে ভেজা চেতনার মানুষের সংখ্যাও নিশ্চয় কম নয় এখনো। শেষ করব ২১ ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে শিল্পী অরিজিত দে’র গাওয়া একটা গানের শেষাংশের কয়েকটা লাইন দিয়ে।
‘আজ দুনিয়ায় সঠিক বেঠিক হাজার দাবির ভীড়ে/একুশ অতীত একুশ ধূসর একুশ হারায় ধীরে/বন্ধু এখন সময় এবার, শপথ নেবার পালা/একুশ ক্ষত টাটকা রেখো, জুড়িয়ে না যায় জ্বালা/একুশ যদি আবার আসে আবার তুফন তোলে/আমার আবেগ শানিয়ে রাখি শহীদ হবো বলে।’
লেখক : সাংবাদিক