ডেস্ক রিপোর্ট : নিয়ন্ত্রণহীন ও নিম্নমানের বেসরকারি চিকিৎসা সেবায় আর্থিক ও স্বাস্থ্যজনিত ক্ষতির শিকার হচ্ছেন সেবাগ্রহীতারা। কমিশন ব্যবসা ও বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধের মাধ্যমে সুশাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি। গতকাল টিআইবি’র (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে ‘বেসরকারি চিকিৎসাসেবা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির পক্ষ থেকে এমন চিত্র তুলে ধরা হয়। বেসরকারি চিকিৎসা সেবার মানোন্নয়নসহ এ খাতে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে টিআইবি ১৬টি সুপারিশও পেশ করে। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাত নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করার প্রস্তাব করা হয় সুপারিশে। স্বাধীন কমিশন গঠন ছাড়াও টিআইবি’র অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাত নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির জন্য খসড়া আইনটি চূড়ান্ত করে আইন হিসেবে প্রণয়ন করা এবং নিয়ন্ত্রণ ও পরিদর্শন কার্যক্রম জোরদার করার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রয়োজনীয় নীতিগত সহায়তার অভাব, পরিদর্শন ও তদারকির ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি এবং অতি মুনাফাভিত্তিক প্রকট বাণিজ্যিকীকরণের সম্মিলিত প্রভাবে বেসরকারি চিকিৎসাসেবা খাত কার্যত নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। রাজধানী ঢাকার বাইরে বেসরকারি ব্যক্তি মালিকানাধীন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনিয়ম সবচেয়ে বেশি। গবেষণাটি জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ২০১৭ সময়ের মধ্যে পরিচালিত হয়। বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ঢাকা মহানগরীর ২৬টি ও ঢাকার বাইরে আট বিভাগের ৯০টি প্রতিষ্ঠানসহ মোট ১১৬টি নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান থেকে গবেষণার তথ্য সংগৃহীত হয়। এর মধ্যে ৬৬টি হাসপাতাল এবং ৫০টি রোগ-নির্ণয় কেন্দ্র। এই গবেষণায় বেসরকারি চিকিৎসাসেবা বলতে ব্যক্তি মালিকানাধীন নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং রোগ-নির্ণয় কেন্দ্র প্রদত্ত সেবাকে বোঝানো হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, সকল অংশীদারের সমান সাড়ার অভাব, স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে উদ্যোগ সত্ত্বেও এ খাতের জন্য পৃথক আইন চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। আইনি সীমাবদ্ধতা, বিদ্যমান যে আইন রয়েছে তা বর্তমান ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে হালনাগাদ না হওয়া, আইন ও নীতির প্রয়োজনীয় প্রয়োগ না হওয়া এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ, পরিদর্শন ও তদারকি কার্যক্রমে ঘাটতিসহ সরকারের যথাযথ মনোযোগের ঘাটতির কারণে বেসরকারি চিকিৎসাসেবা খাত নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। এর ফলে অতি মুনাফাভিত্তিক বাণিজ্যিকীকরণের প্রবণতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সেবার অতিরিক্ত মূল্য আদায়সহ কিছু ব্যক্তির এ খাত থেকে বিধি-বহির্ভূত সুযোগ-সুবিধা আদায়ের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ করে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সক্ষমতার ঘাটতি ও অনিয়মের প্রবণতা অধিকতর লক্ষণীয়। অবকাঠামো, জনবল ও যন্ত্রপাতির ঘাটতিসহ সার্বিক সক্ষমতায় ঘাটতি থাকায় সেবাগ্রহীতারা সঠিক ও মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি আর্থিক ও স্বাস্থ্যগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দেশের চিকিৎসাসেবার প্রতি আস্থা হারিয়ে সেবাগ্রহীতাদের বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গবেষণার পর্যবেক্ষণে বলা হয়, নিবন্ধন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকার অবৈধ লেনদেন হচ্ছে এবং প্রতিষ্ঠানের অবস্থান, মালিক বা অংশীদারদের প্রভাব-প্রতিপত্তির ওপর এ অর্থের পরিমাণ নির্ভর করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট তদারকি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিদর্শনের তারিখ হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোকে পূর্বেই জানিয়ে দেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠান ওই নির্দিষ্ট দিনের জন্য জনবল ও প্রয়োজনীয় নথিপত্র সঠিক রাখে। কিছু ক্ষেত্রে নবায়নের সকল শর্ত পালনে ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও সর্বনিম্ন পাঁচশ’ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায়ের মাধ্যমে নিবন্ধন নবায়নের সুযোগ প্রদান করা হচ্ছে। অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর ঘটনায় ভুক্তভোগীদের অভিযোগ করার কোনো আইন নেই। বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতাল ও রোগ-নির্ণয় কেন্দ্র নিবন্ধিত না হয়েই কার্যক্রম শুরু করে এবং দেশব্যাপী কতগুলো অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার কোনো তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। অধিক মুনাফা অর্জনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনেক সময় প্রসূতিকে সিজারিয়ান প্রসবে উদ্বুদ্ধ করার অভিযোগ রয়েছে।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, উচ্চ মুনাফাভিত্তিক ব্যবসা হিসেবে বেসরকারি চিকিৎসা সেবা খাত বিকাশ হচ্ছে। এখানে তদারকির অভাব রয়েছে। সাধারণ মানুষ চিকিৎসা সেবা নিতে গিয়ে প্রতারিত হচ্ছে। এজন্য এই বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাত নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করা দরকার। বেসরকারি খাত নিয়ন্ত্রণের জন্য বিধিমালা নেই। মান নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না। জনগণ প্রতারিত হচ্ছে। এর থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান উপস্থিত ছিলেন। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার তাসলিমা আক্তার ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোহাম্মদ জুলকারনাইন। মানবজমিন