শিরোনাম
◈ ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় দফায় ভোট পড়েছে ৬০.৭ শতাংশ ◈ তীব্র তাপদাহে স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত গণবিরোধী: বিএনপি ◈ রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় কাজ করবে বাংলাদেশ-থাইল্যান্ড: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ◈ বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী ◈ বিএনপি দিনের আলোতে রাতের অন্ধকার দেখে: ওবায়দুল কাদের ◈ উপজেলা নির্বাচনে হার্ডলাইনে বিএনপি, ৭৩ নেতা বহিষ্কার ◈ যুদ্ধ বন্ধের শর্তেই ইসরায়েলি জিম্মিদের ছাড়বে হামাস ◈ হরলিক্স আর স্বাস্থ্যকর পানীয় নয়  ◈ বাংলাদেশে চিকিৎসা সুবিধায় থাইল্যান্ডের বিনিয়োগ চান প্রধানমন্ত্রী ◈ যে কোনো ভিসাধারী পবিত্র ওমরাহ পালন করতে পারবেন 

প্রকাশিত : ১৬ জানুয়ারী, ২০১৮, ০৬:১৭ সকাল
আপডেট : ১৬ জানুয়ারী, ২০১৮, ০৬:১৭ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

তাবলীগের গণ্ডগোলে কান্ধলভীর প্যাঁচাল

আনিস আলমগীর : বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিতে ভারত থেকে আসা একজন অতিথিকে নিয়ে যখন দেখলাম ঢাকা বিমানবন্দর অচল হওয়ার অবস্থা তখন ফেইসবুকে লিখেছিলাম, ‘বিশ্ব ইজতেমা এক বছর বন্ধ রাখা দরকার। কিছু অন্ধ লোক এটাকে হজের বিকল্প ভেবে গুনাহ করে যাচ্ছে, বন্ধ রাখা হলে এই অন্ধ বিশ্বাস ভাঙবে।’ অনেকে কথাটা পছন্দ করেছেন। বেশিরভাগই পক্ষে মতামত দিয়েছেন। তবে কেউ কেউ ভেবেছেন হয়তো আমি ইজতেমা বিরোধী বা তাবলীগ জামাতের বিরোধী- তাই ইজতেমার পক্ষে নই। আমি হজের মতো প্রতি বছর বিশ্ব ইজতেমার এই আয়োজন দেখে যাতে লোকজন এটিকে হজের বিকল্প না ভাবে, বলেছি সে উদ্দেশ্যে।

এটা সত্য যে আমি তাবলীগের কোনো কার্যক্রমে অংশ নেইনি তবে তাদের সম্পর্কে বিরূপ ধারণা রাখি না। জানি যে, তাবলীগ জামাত চাঁদা নিয়ে চলে না। তুরাগের তীরে যে বিশ্ব ইজতেমা হয় তাতে প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী নিজ নিজ টাকা খরচ করে আসেন। নিজ তহবিলের টাকা খরচ করে খাওয়া দাওয়া করেন। সুতরাং বিশ্ব তাবলীগ জামাতের কোটি কোটি টাকার কোনো তহবিল নেই। সব কাজই তারা নিজে নিজে করেন।

টঙ্গির বিশ্ব ইজতেমার ময়দানে যে প্যান্ডেল তৈরী করা হয় তা তাবলীগের সাথীদের স্বেচ্ছাশ্রমে তৈরী হয়। সরকারের সহযোগিতাও থাকে। পূর্বে আদমজী জুটমিল চটের কাপড় সরবরাহ করতো মাথার উপরে চাঁদ তৈরি জন্য। আদমজী জুটমিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অন্যরা সরবরাহ করেন। বাঁশসহ সবকিছু তাবলীগকে যারা ভালো পান তারা সরবরাহ করে থাকেন।

দেখলাম বর্তমান তাবলীগের যে গণ্ডগোলের কারণে তাবলীগ জামাতের নিরিহ ভাবমূর্তি ব্যাহত হচ্ছে তা কোনো টাকা পয়সার জন্য নয়। শুধু হযরত ইলিয়াস (রাঃ) এর নাতি মওলানা সাদ কান্ধলভীর ইসলাম সম্পর্কে বিতর্কিত বক্তব্য দেওয়ার কারণে। হযরত ইলিয়াস (রাঃ) তাবলীগের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি যখন ভারতের কিছু কিছু অংশে দেখলেন যে মুসলমানেরা নামাজও আদায় করে আবার লক্ষ্মীর পূজাও করে তখন হযরত ইলিয়াস (রাঃ) তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আপনারা নামাজও আদায় করেন আবার লক্ষ্মী পূজাও করেন কেন? তখন তারা বলেছিলেন, নামাজ আদায় করি আল্লাহর জন্য আর লক্ষ্মী পূজা করি ধন দৌলতের জন্য।

এই ঘটনা থেকে ইলিয়াস (রাঃ) বুঝেছিলেন যে মুসলমান সমাজকে সহি শুদ্ধ দ্বীনের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো শিক্ষা দিতে হবে, না হয় মুসলমানদের আমল আকিদা শুদ্ধ হবে না। তখন তিনি কিছু সাধারণ মুসলমানকে ইসলামী জিন্দিগীর প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো শিক্ষা দিয়ে মসজিদে মসজিদে তাবলীগ করার জন্য পাঠালেন। হযরত ইলিয়াস (রাঃ) দেওবন্দ মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। ওই প্রতিষ্ঠানটিকে আমি পছন্দ করি কারণ এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী যে আন্দোলন তার সূচনা এই মাওলানারাই করেছেন। ইতিহাস যারা জানেন না, অতি সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ব্রিটিশ মুভি ‘ভিক্টোরিয়া এ্যান্ড আবদুল’ দেখতে পারেন।

যাক, দেওবন্দের ওস্তাদেরা ইলিয়াস (রাঃ)-এর সাধারণ মানুষ দিয়ে দ্বীন প্রচারের বিষয়টা পছন্দ করেননি। তখন তারা হযরত ইলিয়াস (রাঃ) কে তার জামাত দেওবন্দ মাদ্রাসার মসজিদে পাঠানোর জন্য বলেছিলেন এবং হযরত ইলিয়াস (রাঃ) তার ওস্তাদদের পরামর্শে তাই করেছিলেন। দেওবন্দ মাদ্রাসার ওস্তাদদের সামনে মাদ্রাসা মসজিদে হযরত ইলিয়াস (রাঃ) প্রেরিত জামাতের প্রতিটি সদস্য দ্বীন সম্পর্কে প্রাথমিক ও মৌলিক বিষয়গুলোর উপর বয়ান দেওয়ার পর দেওবন্দ মাদ্রাসার ওস্তাদরা সন্তুষ্ট হন যে ইলিয়াস তার গঠিত জামাতের উপর যে দায়িত্ব প্রদান করেছেন তা সুচারুরূপে পালন করতে পারবেন। ওস্তাদেরা জামাতের সাফল্যের জন্য দোয়াও করেছিলেন। তখন তারা ইলিয়াস (রাঃ) কে তার তাবলীগ গঠনের প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

যেসব কারণে সাদ কান্ধলভীর বিরোধিতা হচ্ছে কারণগুলো খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম ঘটনার পর পর। দেখলাম এই বিতর্ক হঠাৎ করে নয়। এমনকি গত বছরও সাদ কান্ধলভীকে দেওয়া ভিসা বাতিল করেছিল বাংলাদেশ সরকার এবং তার ও তার সঙ্গীদের বাংলাদেশে আসা নিষিদ্ধ করেছিল। এ সংক্রান্ত কয়টি টিভি টক শোও দেখলাম ভারতীয় মিডিয়ায়। তারপরও নানা নাটক করে তিনি এসেছিলেন। ঘটনাটি তখন এতো প্রচার হয়নি যা এবার তাবলীগ কর্মীরা বিমানবন্দর আর টঙ্গীর রাস্তা কয়েকঘণ্টা অচল করে দেওয়ায় হয়ছে।

সাদ কান্ধলভীর যেসব বক্তব্যের কারণে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো খুবই উদ্ভট এবং আপত্তিকর। ইসলাম সম্পর্কে তার কিছু বক্তব্যে দেওবন্দ মাদ্রাসা বিরোধিতা করেছেন। যেখানে ইলিয়াস (রাঃ) তার তাবলীগ জামায়াতের শুরুতে দেওবন্দ মাদ্রাসার ওস্তাদের বক্তব্য শুনতে দ্বিধা করেননি সেখানে তার নাতি সাদ কান্ধলভী তার বক্তব্যের উপর একগুয়ে হয়ে বসে থাকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা সত্যই দূঃখজনক। তাবলীগ জামাতের এতোদিনের নিরিহ ভাবমূর্তি বিনষ্ট হওয়ার জন্য সাদ কান্ধলভীকে দায়ী করা ভুল হবে না।

বিশ্বব্যাপী স্বেচ্ছাশ্রমে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটিকে কারো উচিৎ নয় নষ্ট করে ফেলা। এ প্রতিষ্ঠানটিতেও ইস্রাইলের নজর পড়েছে কিনা কি জানি! মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলিকে ধূলায় মিশিয়ে দেওযার কাজ করছে আমেরিকা ও ইস্রাইল তাদের সে অভিসন্ধি এখানেও যে কাজ করছে না কে বলবে! অন্যদিকে তাবলীগের সঙ্গে জামাতে ইসলামী এবং সৌদি অনুসারীদের বিরোধও আছে দীর্ঘদিন ধরে। তাদের কলকাঠি কতটুকু আছে সেদিকেও নজর রাখা দরকার।

ভারত উপ-মহাদেশে বহু মনিষী পূরুষ তাবলীগ জামায়াতের শিক্ষাকে সহজ করার জন্য এবং সহি করার জন্য ফাজায়েলে নামাজ, ফাজায়েলে কোরআন, ফাজায়ালে রোজা ইত্যাদি বহু গ্রন্থ রচনা করে শিক্ষার মজবুত ভিত্তি রচনা করে দিয়ে গেছেন যেন শতাব্দীর পর শতাব্দী তাবলীগের কাজ কর্মীরা অব্যহত রাখতে পারেন।

আমরা একটা বিষয় উপলব্ধি করেছি যে তাবলীগে শরিক হওয়া লোকদের কাছে অন্য মানুষের চেয়ে আল্লাহ্ ভীতি বেশী, রাজনীতি নিয়ে তারা জামাতে ইসলামের মতো রগকাটা, বোমায় মেরে ফেলা বা আগুণ সন্ত্রাসে বিশ্বাসী না। প্রকৃত অর্থে যাদের কাছে আল্লাহ্ ভীতি বেশী তারা তো সহজে অন্যায়ে লিপ্ত হয় না। বর্তমান দুনিয়ার মানুষ অন্যায় কাজে লিপ্ত হতে দ্বিধা করছেন না। অন্যায়ের মাঝে যখন দুনিয়াটা ডুবে যাচ্ছে, নীতি নৈতিকতার কোনো মূল্য নেই- এমন একটি পরিস্থিতিতে তাবলীগের প্রসার অতীব জরুরী। সাদ কান্ধলভীর বিতর্কিত কথাবার্তায় তো তাবলীগের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ কমে যাবে।

মাওলানা সাদ কান্ধলভী বলেছেন কোরআন শরিফ শিক্ষা দিয়ে যারা বেতন গ্রহণ করেন তাদের উপার্জন নাকি বেশ্যার উপার্জনের চেয়েও খারাপ। মওলানা সাদ কান্ধলভীর কথামতো মওলানারা শিক্ষার কাজ ছেড়ে দিয়ে যদি জীবিকা নির্বাহের জন্য অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে যান তবে শিক্ষকের অভাবে তো মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন তো দ্বীনি শিক্ষার পথ আর খোলা থাকবে না।

হযরত পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রাঃ) ইমাম গাজ্জালী (রাঃ) বাগদাদের বিখ্যাত নিজামিয়া মাদ্রাসার শিক্ষকতা করেছেন। তারা বেতনও নিয়েছেন। তার কথা মতো কি তারা বেশ্যার উপার্জানের চেয় নিকৃষ্ট উপাজর্নের অর্থ দিয়ে উদরপূর্তি করেছিলেন। মাওলানা কান্ধলভী বলেছেন দাওয়াতের পথ নবীর পথ তাসাউফের পথ নাকি নবীর পথ নয়। আল্লাহ্তালা নবী (দঃ) কে পূর্ণতা প্রদান করে অর্থাৎ সব মানুষের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ স্বরূপ (উছওয়াতুন হাসানা) দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। সুতরাং যারা ইসলামে বিশ্বাস করেন তাদের মানতে হবে- সব সৎ পথই মহানবীর পথ। দাওয়াতও তার পথ, তাসাউফও তার পথ।

হযরত মুহাম্মদ (সঃ) নবুয়ত পাওয়ার আগে হেরা গুহায় বছরের পর পর ধ্যানমগ্ন ছিলেন। কার প্রত্যাশায় ধ্যান করেছিলেন? যার জন্য ব্যাকুল হয়ে ধ্যান করেছিলেন তিনি তাকে সম্মানিত করেছেন। তাকে পাওয়ার এই ব্যাকুলতাই তাসাউফ। সুতরাং এলমে তাসাউফ-এর সাধনা যে করে না তার তাবলীগ জামায়াতের নেতৃত্ব দেওয়ার কোনো অধিকার নেই।

হযরত মুহম্মদ (সঃ) পুরোনো নবীদের সম্পর্কে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে কথা বলতেন এবং তাদেরকে ‘আমার ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। মওলানা কান্ধলভী নবী মুসা (আঃ) সম্পর্কে বলেছেন হযরত মুসা দাওয়াত ছেড়ে দিয়ে কিতাব আনতে চলে যাওয়ায় নাকি পাঁচ লক্ষ সত্তর হাজার লোক মুরতাদ হয়ে গিয়েছিলো। হযরত মুসা (আঃ) কর্তৃক নিজের ভাই হারুনের জন্য আল্লাহর কাছে নবুয়ত চাওয়া নাকি উচিৎ হয়নি।

আসলে মাওলানা কান্ধলভী ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক লেখাপড়া করেছেন কিনা জানি না। হেদায়েত যে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহ্র হাতে তা তো কোরাআনের সূরা বাকারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে। তিনি হযরত মুসার (আঃ) কিতাব আনতে যাওয়ার কাজকে নিন্দার চোখে দেখলেন কেন জানি না?

ইসলাম বিশ্বাস করলেতো এটাও বিশ্বাস করতে হবে মুসাকে (আঃ) আল্লাহ্ চার আসমানী গ্রন্থের এক গ্রন্থ দিয়ে সম্মানিত করেছেন। সুতরাং তিনি তো কিতাব আনতে তুর পর্বতে যাবেনই। আর তার ভাই সম্পর্কে তিনি বলেছেন তার জন্য নবুয়ত চাওয়া নাকি ঠিক হয়নি। কান্ধলভী জানেন কিনা জানি না হযরত মুসা (আঃ) তোতলা ছিলেন। আমভাবে দ্বীনের বয়ান দেওয়া তার পক্ষে কষ্টের ছিলো আর সর্ব সাধারণের পক্ষে মুসার (আঃ) কথা বুঝাও কষ্টকর ছিলো। তাই তিনি তার ভাইকে তার সহকারী হিসেবেই চেয়েছিলেন যা আল্লাহ্ মঞ্জুর করেছিলেন। এটা নিয়ে কান্ধলভী মুসা (আঃ) দোষ খোঁজা উচিৎ হয়নি।

যাক। কান্ধলভীর সব কথা এখনও আমার হাতে আসেনি। হস্তগত হলে কোনটা সঠিক কোনটা বেঠিক তা নিয়ে পর্যালোচনায় করতাম। অবশ্য ক্যামরাওয়ালা মোবাইল ফোন পকেটে রাখা কিনবা তাবলীগ না করলে বেহেশেতে যাবে না- এমন ফালতু কথার উত্তর দেওয়ারও সময় নেই। কান্ধলভীকে বলব তার বয়স বেশী হয়নি যেন তাওবা করে আল্লাহ্র কাছে সঠিক পথের প্রার্থনা করেন। আর তাবলীগের কাজকে বিতর্কিত করার পথ পরিহার করে চলেন। আর ভুলেও যেন বাংলাদেশে না আসেন। আমরা আমাদের মোল্লা- মাওলানাদের নানান প্যাচালে হয়রান। বিদেশী মোল্লার প্যাচাল সামলানোর সময় কই!

লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
anisalamgir@gmail.com । পরিবর্তন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়