শিরোনাম
◈ প্রস্তাবিত আচরণবিধি: নির্বাচনী প্রচারে নতুন কড়াকড়ি, বিদেশে সভা-সমাবেশ ও পোস্টার নিষিদ্ধ ◈ ভারত ভেঙে ছোট ছোট দেশ গঠনের প্রস্তাব অস্ট্রিয়ার অর্থনীতিবিদের ◈ আরও ৩০ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠাল যুক্তরাষ্ট্র ◈ ডাকসুতে বাকেরকে সমর্থন দিয়ে সরে দাঁড়ালেন মাহিন ◈ পুলিশের নজর বিশেষ সাড়ে ৩ ঘন্টায়, কি হতে চলেছে ঢাকায়? (ভিডিও) ◈ ২০১৪ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনে কৌশলগত ভুল করেছিল ভারত: প্রফেসর শ্রী রাধা দত্ত (ভিডিও) ◈ হকি বিশ্বকাপের বাছাই প‌র্বে খেলার সম্ভাবনা জাগা‌লো বাংলাদেশ ◈ তালা দিবা, হাতাহাতি করবা তোমরা আর ইলেকশন আমাকে করে দিতে হবে: রাবি ভিসির ক্ষোভ (ভিডিও) ◈ জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবি ও আসন্ন নির্বাচনী রাজনীতি‌তে কোন সমীকরণ কাজ কর‌ছে ◈ পর্যাপ্ত প্রমাণ মেলেনি, ধর্ষণের অভিযোগ থেকে মুক্ত পা‌কিস্তা‌নের ক্রিকেটার হায়দার আ‌লি 

প্রকাশিত : ১৫ মে, ২০২৫, ১২:০১ দুপুর
আপডেট : ২৯ আগস্ট, ২০২৫, ০৯:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বাংলাদেশে নারী নির্যাতন : কক্সবাজার টু মুন্সিগঞ্জ

ডয়চে ভেলে: ২৪ সেপ্টেম্বরের কক্সবাজার আর ৯ মে-র মুন্সিগঞ্জের ঘটনায় অমিলের চেয়ে মিলই বেশি। দুটি ঘটনাতেই নারীকে পেটানো হয়েছে প্রকাশ্যে। সারা দেশে জানাজানির পর গ্রেপ্তার হয়েছে একজন। বাকিরা নির্বিঘ্নে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। 

মুন্সিগঞ্জে লঞ্চঘাটে দুই তরুণীকে প্রকাশ্যে বেল্ট দিয়ে পেটানোর ঘটনায় অবশেষে এক তরুণকে আটক করে দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হলেও বাকিরা এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। 

গত শুক্রবার রাত সাড়ে আটটার দিকে মুন্সিগঞ্জ লঞ্চঘাটে ওই ঘটনা ঘটলেও দুই তরুণীকে মারধরের পর কেউ আটক হয়নি। কোনো মামলাও তখন হয়নি। পরে মারধরের ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে নৌ পুলিশের একজন সাব-ইন্সপেক্টর নিজেই বাদী হয়ে মামলা করেন এবং একজনকে আটক করা হয়।

ভিডিওতে দুই তরুণীকে প্রকাশ্যে পিটাতে দেখা যায়। নেহাল আহমেদ ওরফে জিহাদ নামে যে যুবক পিটাচ্ছিলেন তার সঙ্গে আরো অনেকেই ছিলেন। তাদের কেউ কেউ সেই দৃশ্য মুঠোফোনে ভিডিও করছিলেন, কেউ কেউ আবার ‘‘মার, মার'' বলে হাততালি দিচ্ছিলেন।

এমভি ক্যাপ্টেন নামের লঞ্চে করে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে প্রায় ৪০০ যাত্রী শুক্রবার বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে নৌ ভ্রমণ শুরু করেন। প্রথমে লঞ্চটি ঢাকার সদরঘাটে থামে। সন্ধ্যার দিকে লঞ্চটি চাঁদপুরের মোহনপুরের উদ্দেশে সদরঘাট থেকে ছেড়ে যায়। এরপর রাত সাড়ে আটটার দিকে নাশতা নেওয়ার জন্য মুন্সিগঞ্জ লঞ্চঘাটে লঞ্চটি থামানো হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তামুন্সিগঞ্জ মোক্তারপুর নৌ পুলিশ ফাড়ির সাব- ইন্সপেক্টর ইমরান আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ওই দুই তরুণী লঞ্চ ঘাটের একটি দোকানে জুস কিনতে গেলে কয়েক তরুণ তাদের পোশাক নিয়ে আপত্তিকর কথা বলে। তারা প্রতিবাদ করে লঞ্চে ওঠার জন্য লঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলে এক তরুণ বেল্ট দিয়ে দুই তরুণীকে পোটায়। এক পর্যায়ে তারা ভয়ে লঞ্চের ভিতরে চলে যায়। ওই তরুণের সঙ্গে আরো ২০-২৫ জন ছিল। 

মারধর শুরুর পরই সদর থানার পুলিশ এবং বন্দর নৌ পুলিশ ফাঁড়ির পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। তখন চাইলে তরুণদের আটক করে মামলা নেওয়া যেতো। কিন্তু পুলিশ সেই ব্যবস্থা নেয়নি। মারধরকারী তরুণরা মারধর করে বিনা বাধায় চলে যায়। 

তদন্ত কর্মকর্তা জানান, তিনি নিজেও দ্রুত লঞ্চঘাটে গিয়েছিলেন। তাহলে  ওই তরুণদের তখন কেন গ্রেপ্তার করা হলো না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা তো তখন মামলা করেনি। মামলা না করলে গ্রেপ্তার করবো কীভাবে?

মামলা হয়েছে ২৫ জনের বিরুদ্ধে, কিন্তু এখনো মাত্র একজনকে গ্রেপ্তারের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা তো সবাই অজ্ঞাত। ফুটেজে সবার ছবি থাকলেও তাদের চিহ্নিত করতে সময় লাগবে। আমরা তো আর তাদের চিনি না।

ওই দুই তরুণীর নাম ঠিকানা আমরা সংগ্রহ করেছি। কিন্তু এখনো কথা বলতে পারিনি। তাদের মধ্যে একজন নোয়াখালীর এবং আরেকজন নারায়ণগঞ্জ বন্দর এলাকায় থাকেন। তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলবো, বলেন তিনি।

নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইন্সপেক্টর আতাউর রহমান বলেন, ওই তরুণরা পিকনিকের লঞ্চে অসামজিক কাজ ও মাদক সেবনের অভিযোগও তোলে। দুই তরুণীকে পিটানোর পর লঞ্চে হামলাও করে তারা। তারা  লঞ্চের ২২টি কাঁচ ভেঙে ফেলে।

তিনি আরো বলেন, ওই লঞ্চে প্রায় ৪০০ যাত্রী থাকলেও তারা প্রতিবাদের সাহস পায়নি। কারণ, হামলার নেতৃত্ব দেয়া নেহাল আহমেদ ওরফে জিহাদ নিজেকে স্থানীয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয় দেয়। পুলিশও একটু পরে গিয়ে ব্যবস্থা নিতে সাহস পায়নি।

তিনি জানান, এর আগেও একইভাবে লঞ্চে হামলা হয়েছিল। তখনো নারীদের ওপর হামলা হয়। কিন্তু তখন কোনো মামলা হয়নি। ভিডিও ছড়ায়নি। ফলে চাপা পড়ে যায়।

তার কথা, এবারের ঘটনায়ও তারা কেউ মামলা করেনি। পরে আমরা নিজেরাই সদর থানায় মামলা করেছি। 

তবে পুলিশ মামলা করে ওই তরুণকে আটকের পর। ভিডিও ভাইরাল হলে পুলিশ তাকে আটক করতে বাধ্য হয়। শনিবার নেহাল আহমেদকে আটক করা হয়। রবিবার সকালে নৌ পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ মিলন বাদী হয়ে জিহাদ ও অজ্ঞাতনামা ২০-২৫ জনকে আসামি করে মুন্সিগঞ্জ সদর থানায় মামলা করেন। 

আটকের পর ওই তরুণ বলে, আমার ভুল হয়েছে। তাকে দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।

নারীকে প্রহার, নিপীড়ন বাড়ছে

গত ৬ মে কুড়িগ্রামের উলিপুরে গ্রাম্য সালিসে 'অনৈতিক সম্পর্কের'  অপবাদ দিয়ে এক নারীর চুল কেটে নেওয়া হয়। পুলিশ বলছে, এ ঘটনায় তারা কোনো অভিযোগ পায়নি, পেলে ব্যবস্থা নেবে। 

গত ৫ মে কুষ্টিয়ায় শারমিন সুলতানা নামে এক নারী চিকিৎসককে একটি ডায়াগনিস্টিক সেন্টারের সামনে রিকশা থেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে প্রকাশ্যে মারধর করা হয়। তার স্বামীও ওই হামলা থেকে রেহাই পাননি। 

ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে হামলাকীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে মানবন্ধন করেন চিকিৎসকসহ নানা পেশার সাধারণ মানুষ। পরে পুলিশ হামলায় জড়িত চারজনকে গ্রেপ্তার করে।

২ এপ্রিল ঢাকার বনশ্রী এলাকায়  এক নারী সাংবাদিককে রাত ৮টার দিকে প্রকাশ্যে মারধর ও যৗন হয়রানি করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়লে একদিন পর চারজনকে আটক করে পুলিশ।

১৪ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌর শহরের সড়ক বাজারে জনসমক্ষে দুই নারীর মাথার চুল জোরপূর্বক কেটে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে স্থানীয় ব্যবসায়ী সুমন দাসের বিরুদ্ধে। ওই দুই নারীকে প্লাস্টিকের পাইপ ও রড দিয়ে বেধড়ক মারধরের অভিযোগও পাওয়া গেছে।

২০ মার্চ কুড়িগ্রামের রৌমারিতে সরকারি রাস্তায় দেয়াল নির্মাণে বাধা দেয়ায় সাফিয়া বেগম নামে এক নারীকে প্রকাশ্যে মারপিট করে সৈয়দ জামাল ও তার ছেলে সাঈদুল হক। ওই নারী হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে থানায় অভিযোগ করলেও আসামিরা গ্রেপ্তার হয়নি। 

গত ২২ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুরের সদর উপজেলার লাহারকান্দি এলাকায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে দুই নারীকে প্রকাশ্যে মারধর করে মোহাম্মদ রাশেদ আলম নামে এক ব্যক্তি।ওই দৃশ্য ভিডিও করা হয় এবং পরে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই দুই নারীকে শক্ত লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। তারা হাসলপাতালে ভর্তি হওয়ার পর এবং ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ তৎপর হয়। কিন্তু তার আগেই নির্যাতনকারীরি গা-ঢাকা  দেয়।

এমন আরো ঘটেছে বাংলাদেশে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে দুই নারীকে হয়রানি ও মারধর করা হয়। তাদের পোশাক ‘খারাপ' বলে একদল যুবক তাদের মারধর করে। 

পরে মাধরের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। তারপর পুলিশ মো. ফারুকুল ইসলাম নামে একজনকে আটক করে। কিন্তু তার সযোগীদের কেউ আটক হয়নি।

‘নারীবিদ্বেষীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে'

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু ডয়চে ভেলেকে বলেন, আসলে এখন একটি গোষ্ঠী আর চায় না যে, নারীরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করুক। তাই তারা প্রকাশ্যে, রাস্তায় জনসমাগম স্থলে নারীর ওপর হামলা চালাচ্ছে। হামলার সময় কেউ প্রতিরোধে এগিয়েও যাচ্ছে না। সেখানে পুলিশ থাকলেও তারা নির্বিকার থাকে। আর কোনো ঘটনায় আমরা তেমন পদক্ষেপ নিতে দেখছি না। তাই নারীবিদ্বেষীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে।” 

তার কথা, ঢাকায় প্রকাশ্য সমাবেশে নারীবিদ্বেষীরা নারীদের নিয়ে অশ্লীল গালাগালকরলো সরকার কোনো ব্যবস্থা নিলো না। তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হলো না। তাহলে এই নারীবিদ্বেষী প্রবণতা ও সহিংসতা তো আরো বাড়বে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা নারীরা তো এর প্রতিবাদ করছি। রাস্তায় নেমেও প্রতিবাদ করছি। কিন্তু শুধু নারীরা কী করছে এই প্রশ্ন করা ঠিক না। আসলে সমাজের সাবাইকে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। এটাকে শুধু নারীদের বিষয় হিসাবে দেখার মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)-এর হিসাব অনুযায়ী এপ্রিল মাসে ৩৬২ টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ৯৩টি, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ২৫টি, ধর্ষণ ও হত্যার চারটি ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে আট জন প্রতিবন্ধী কিশোরী এবং নারীও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। 

এপ্রিল মাসে ধর্ষণের শিকার ৯৩ জনের মধ্যে ১২ জন শিশু, ৪৩ জন কিশোরীও রয়েছে। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকারহয়েছেন চার জন শিশু, আট জন কিশোরী ও ৯ জন নারী এবং ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছেন চার জন নারী। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা ৩৩টি, যৌন হয়রানি ২৬টি, শারীরিক নির্যাতনের ৪৭টি ঘটনা ঘটেছে। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, আসলে সরকারেই এখন অনেকে রয়েছে, যারা নারীদের ঘরে রাখতে চান। তাদের কথায় প্রভাব পড়ে। আর সারা দেশে তাদের অনুসারী আছে। তারাই নারীদের এভাবে পিটিয়ে, হেনস্তা করে ঘরে ঢুকাতে চাইছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ে এক ছাত্রীকে হেনস্তা করা হলো। কিন্তু হেনস্তাকারীকে জামিন দিয়ে মাথায় পাগড়ি আর গলায় মালা দেয়া হলো। ওই ঘটনাও প্রমাণ করে যে কীভাবে নারীদের ঘরে ঢোকানোর কাজ হচ্ছে।

'আর এখন তো পুলিশ ভয়ে আছে। আগেও ছিল। ফলে এই ধরনের ঘটনায় তারা অ্যাকশনে যায় না। প্রশাসনের লোকও চায় ঘটনা ধামাচাপা পড়ুক, কেউ না জানুক। কিন্ত যখন প্রকাশ হয়ে যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসে. সমালোচনা হয় তখন তারা উপরের নির্দেশে কিছু লোক-দেখানো ব্যবস্থা নেয়। উপরের নির্দেশও আগে যায় না। সবাই জেনে গেলে যায়।' 

জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন হারুন উর রশীদ স্বপন। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের। 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়