এফএনএসের প্রতিবেদন।। বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) উন্নয়ন দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, জাপান, ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যেই শিল্প, ব্যবসা, গবেষণা, এবং সরকার পরিচালনায় এআই প্রযুক্তিকে ব্যাপকভাবে সংযুক্ত করেছে। তবে বাংলাদেশে এর ব্যবহার এখনো সীমিত পর্যায়ে রয়েছে। বাংলাদেশে কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্টার্টআপ এবং প্রযুক্তি ভিত্তিক সংস্থা এআই নিয়ে কাজ করছে। বিশেষ করে ফিনটেক (ফিন্যান্সিয়াল টেকনোলজি), স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, ই-কমার্স, এবং কাস্টমার সার্ভিস-এ কিছু পর্যায়ে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। তবে এটির বিস্তার এখনো আশানুরূপ নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির উন্নয়নে বিশ্বের ১৭৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩তম বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
দেশের তরুণদের মধ্যে ৮৪ শতাংশের এআই পরিচালনায় উপযুক্ত দক্ষতা নেই এমন তথ্য সামনে এনে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) বলেছে, সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া এখনই প্রয়োজন। বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহারের বর্তমান অবস্থা, এর সম্ভাবনা, এবং পিছিয়ে থাকার কারণ নিয়ে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটি দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশে এআই প্রযুক্তির প্রসার সীমিত হওয়ার পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন প্রযুক্তি সংশ্লিষ্টরা। এরমধ্যে প্রধানতম কারণ হলো, প্রযুক্তিগত পরিকাঠামোর সীমাবদ্ধতা। দেশে অত্যাধুনিক কম্পিউটিং সিস্টেম, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ডেটা সেন্টার, এবং এআই গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় হাই-এন্ড প্রযুক্তির অভাব এআই-এর বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। দ্বিতীয়ত, দক্ষ জনবল ও প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে।
এআই প্রযুক্তি উন্নয়ন ও প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন দক্ষ প্রযুক্তিবিদ, গবেষক, ও প্রোগ্রামার। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো এআই-সংক্রান্ত উচ্চ পর্যায়ের গবেষণা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ সীমিত। অন্যদিকে, তথ্য ও ডেটা ব্যবস্থাপনার সমস্যা এআই এর বিস্তার না হওয়ার অন্যতম একটি কারণ। কেননা এআই সিস্টেমের কার্যকারিতা নির্ভর করে বিশাল পরিমাণ ডেটার উপর। উন্নত দেশগুলোতে বিভিন্ন খাত থেকে সংগৃহীত ও বিশ্লেষিত ডেটার মাধ্যমে উন্নত এআই তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে ডেটা সংগ্রহ, সংরক্ষণ, এবং ব্যবহারের নীতিমালা এখনো পর্যাপ্তভাবে গড়ে ওঠেনি। এছাড়া, আরেকটি বড় বাধা হলো, বিনিয়োগ ও নীতিগত বাধা। এআই গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য যে বড় আকারের সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ প্রয়োজন, দেশে স্টার্টআপ ও প্রযুক্তি কোম্পানির সংখ্যা বাড়লেও, তাদের পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও সরকারি সহযোগিতা মিলছে না। এছাড়া, স্পষ্ট ও কার্যকর এআই নীতিমালা না থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠান এই ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে দ্বিধাগ্রস্ত। যদিও মনে করা হচ্ছে, এআই প্রযুক্তি বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে বিপ্লব ঘটাতে পারে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ এআই ব্যবহার করে বিকল্প শিক্ষা পদ্ধতি, ব্যক্তিগতকৃত লার্নিং, এবং অনলাইন প্রশিক্ষণ উন্নত করা সম্ভব।
এআই ভিত্তিক রোগ নির্ণয়, মেডিকেল ডাটা বিশ্লেষণ, এবং স্বাস্থ্য পরামর্শ ব্যবস্থা উন্নত করে দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার মান বাড়ানো যেতে পারে। বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে ফসলের রোগ শনাক্তকরণ, বৃষ্টি ও আবহাওয়া পূর্বাভাস, এবং কৃষকের জন্য স্মার্ট পরামর্শদাতা হিসেবে এআই ব্যবহার করা সম্ভব। বাংলাদেশের ই-কমার্স, ব্যাংকিং, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, এবং গ্রাহক সেবায় এআই ব্যবহার করলে ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণ আরও উন্নত হতে পারে। সরকারি সেবাগুলোর ডিজিটাইজেশন ও স্বয়ংক্রিয়করণ, যেমন ই-গভর্নেন্স, বুদ্ধিমান ডাটা বিশ্লেষণ, এবং সাইবার নিরাপত্তার উন্নয়নে এআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশে এআই-এর উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ জানিয়েছেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশে এআই প্রযুক্তির প্রসার ও সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন উন্নত প্রযুক্তিগত পরিকাঠামো তৈরি, উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন প্রশিক্ষণ ও গবেষণা চালানো, ডেটা সংগ্রহ ও ব্যবহারের কার্যকর নীতিমালা তৈরি, সরকার ও বেসরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং এআই-সংক্রান্ত স্পষ্ট ও কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন।
সঠিক পরিকল্পনা, দক্ষ জনবল, এবং প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ এআই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সফল হতে পারে। এআই-এর সুযোগ গ্রহণ করলে উন্নয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি, এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকবে না, বরং বিশ্ববাজারে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। বিসিআই সভাপতি, আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী বলেন, বর্তমানে দেশের শিল্প খাতের জন্য এআই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্ব যখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশকেও প্রযুক্তিজ্ঞানে দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে।
যুবসমাজ আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। তাদের এআই দক্ষতায় প্রশিক্ষিত করে তুলতে পারলে দেশের কর্মসংস্থান ধরে রাখা ও শিল্পোন্নয়ন সহজ হবে। বিসিআই’র সেক্রেটারি জেনারেল ড. মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের সম্ভাবনা প্রচুর, তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। এআই প্রযুক্তি দ্রুত বিকশিত হচ্ছে, তাই এখনই সময় যথাযথ পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণের। আইএমএফের সর্বশেষ এআই সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩ তম, যা উন্নত দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে।