স্টেটসম্যানের সম্পাদকীয়: প্রায় দুই দশকের নির্বাসনজীবন শেষে তারেক রহমানের বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন কেবল ব্যক্তিগত রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন নয়। এটি দেশে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী পুনর্গঠনের এক সুনির্দিষ্ট মুহূর্তকে চিহ্নিত করে। এটি সেই মুহূর্ত যখন দেশে পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা, বৈধতা ও ‘মেমোরি’ পুনর্বিন্যাস ঘটছে একসঙ্গে। শেখ হাসিনার নাটকীয় পতনের পর যে রাজনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, সেখানে তারেক রহমানের আবির্ভাব নতুন এক বিকল্প ব্যবস্থার ইঙ্গিত দেয়। বহু বাংলাদেশির কাছে তিনি ভাঙনের নয়, ধারাবাহিকতার প্রতীক।
জিয়া পরিবারের উত্তরাধিকারী ও বিএনপির প্রধান মুখ হিসেবে তিনি দীর্ঘদিনের বংশানুক্রমিক রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার এক পরিচিত ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করেন। তবুও সময়ের গুরুত্ব থেকেই যায়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন নিয়ে এক সম্পাদকীয়তে এসব কথা লিখেছে ভারতের প্রভাবশালী দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকা।
তার প্রত্যাবর্তন এমন এক মুহূর্তে ঘটেছে, যখন বছরের পর বছর দমনপীড়ন, সহিংস আন্দোলন ও বিচারব্যবস্থার রাজনৈতিকীকরণের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক আস্থার ভিত ক্ষয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে পরিচিত মুখ আশ্বাস জাগাতে পারে- যদিও তার সঙ্গে থাকে অমীমাংসিত অনেক বিষয়। আগের সরকার পতনের পর তার বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো খারিজ হয়ে গেছে। সমর্থকদের কাছে এই অব্যাহতি পাওয়া সাবেক সরকারের নিপীড়নের প্রমাণ হলেও, সমালোচকদের দৃষ্টিতে জবাবদিহির বিষয়টি সামনে এসেছে।
বিপদটি এখানেই- আইনি সমাপ্তিকে যদি নৈতিক নিষ্পত্তি বলে ভুল ধরা হয়। স্বচ্ছ বিচারবিশ্লেষণ ছাড়া স্থিতির বিনিময়ে রাজনৈতিকভাবে বিস্মৃতি যদি মূল্য হিসেবে গৃহীত হয়- তবে সেই হিসাব-নিকাশ অসম্পূর্ণই থেকে যায়। তবে জনতার উচ্ছ্বাসকে গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণ হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। জনতার উচ্ছ্বাস ও সমর্থন ইঙ্গিত দিতে পারে, কিন্তু বছরের পর বছর ধরে নির্বাহী আধিপত্যের কারণে দুর্বল হয়ে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকল্প নয়।
বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন কাঠামো, স্বাধীন আদালত ও রাজনৈতিক সংযমের সংস্কৃতি না থাকলে তাতে ঝুঁকি থেকেই যায়। সেই অর্থে আসন্ন নির্বাচনের গুরুত্ব কেবল আসনসংখ্যার অঙ্কে নয়- বরং এই প্রশ্নে যে, এখান থেকে কী ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠবে। পূর্বতন শাসকদল কার্যত প্রান্তিক হয়ে পড়ায় এই প্রতিযোগিতা প্রতিনিধিত্বের চেয়ে উত্তরাধিকারের লড়াইয়ে রূপ নেয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
তারেক রহমানের জনসমর্থননির্ভর জনপ্রিয়তা দলগত সাংগঠনিক শক্তি ও জমে থাকা বিরোধী শক্তির উন্মোচন ঘটালেও একই সঙ্গে তাতে রাজনৈতিক বিকল্পের পরিসর প্রসারিত করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক পাল্টা ভারসাম্য নিয়েও আলোকপাত করে। ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে এই রূপান্তরকে তাই আবেগহীন ও সতর্ক বিবেচনায় দেখা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ কেবল প্রতিবেশীই নয়- আঞ্চলিক নিরাপত্তা, সীমান্ত-পরিচালনা ও অর্থনৈতিক সংযোগের এক কৌশলগত অংশীদার। তাদের আভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা আঞ্চলিক নিরাপত্তা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং অর্থনীতিকে সরাসরি প্রভাবিত করে। পুনর্মিলনের বদলে বর্জনের মাধ্যমে জন্ম নেয়া কোনো সরকার দেশে প্রাথমিক বৈধতা পেলেও দীর্ঘমেয়াদে সংহতি ও বহির্বিশ্বের আস্থার পরীক্ষায় পড়তে পারে।
শেষ পর্যন্ত তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন কেবল নেতৃত্বের নয়- শেখারও পরীক্ষা। যদি বাংলাদেশের পরবর্তী অধ্যায় কেবল পুরোনো রাজনৈতিক ভারসাম্যকেই নতুন প্রেক্ষাপটে ফিরিয়ে আনে, তবে অভিযোগ-প্রতিকারের এই চক্র ঘুরতে থাকবে। কিন্তু যদি এই মুহূর্তটি ক্ষমতার ব্যক্তিকেন্দ্রিকীকরণ নয়, প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তবে তারেক রহমানের এই ঘরে ফেরা পুনরাবৃত্তির পূর্বাভাস নয়, বরং এক সম্ভাব্য মোড় বদলের সূচনা হয়ে উঠতে পারে। অনুবাদ: মানবজমিন