আহমেদ শাহাব, ডেট্রয়েট, মিশিগান : শরীফ থেকে শরীফার গল্প নিয়ে সমাজে এখন তুমুল আলোড়ন। একদল বিবেক-যুক্তিহীন মানুষ লেখাটি না পড়েই দেশ গেলো, ধর্ম গেলো ইত্যাদি বলে শোরগোল পাকিয়ে তুলছেন। আরেক দল শিক্ষিত মডারেট ইনিয়ে-বিনিয়ে বলতে চাইছেন, তৃতীয়লিঙ্গ মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু ট্রান্সজেন্ডার? কভি নেহি। যদিও শরীফ থেকে শরীফার গল্পটি একটি খুবই স্পর্শকাতর মানবিক গল্প। আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা, শিক্ষা, পারিপার্শ্বিকতা সমাজে মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষের জন্ম দিতে পারছে না বলেই শিক্ষাবোর্ড ধন্যবাদ আর অভিনন্দন পাওয়ার বদলে একধরনের আসুরিক হট্টগোলের সম্মুখিন হয়েছে। এই গল্পে কোথাও যদিও সমকামিতার কথা নেই, নেই ট্রান্সজেন্ডারের কথাও। আর ট্রান্সজেন্ডারের কথা থাকলেই কেন সমাজ অশুদ্ধ হয়ে যেতো বা যাবে? ১৯৭৬ বা ৭৭ সাল হবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র নাম আব্দুস সামাদ একদিন নিজের মাঝে একটা অদ্ভূত পরিবর্তন অনুভব করেন। পরিবর্তনটি শারীরিক এবং মানসিক উভয় ক্ষেত্রেই। এই পরিবর্তনের কথা লতিফ হলে অবস্থান করা তার সহপাঠীদের সঙ্গে শেয়ার করতেও তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। ফলে পরামর্শ নিলেন একজন চিকিৎসকের। প্রাজ্ঞ সেই চিকিৎসক তার শরীরে ছোট্ট একটা সার্জারি করলেন। ব্যস, আব্দুস সামাদ হয়ে গেলেন হোসনে আরা বেগম। এরপর লতিফ হলের আব্দুস সামাদকে হোসনে আরা হয়ে চলে যেতে হলো মন্নুজান হলে। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, সদ্য রূপান্তরিত হোসনে আরা বেগম একদিন ঘোষণা দিয়েই লাল বেনারসি পরে বিয়ে করে বসলেন সহপাঠী এক বন্ধুকে। উদারমনা বন্ধুটিও তাঁকে স্ত্রী হিসেবে সাদরে গ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা সেই অভূতপূর্ব বিয়েকে নেচে গেয়ে উদযাপন করলেন। সেই রূপান্তর আর বিবাহের গল্প সে সময় পত্রপত্রিকার খুব মুখরোচক এবং কৌতুহলোদ্দীপক সংবাদ হয়ে উঠেছিলো। আমরা তখন প্রবল আগ্রহ নিয়ে সেই সংবাদ পড়েছি। সংবাদের ফলোআপ খোঁজার চেষ্টা করেছি।
না, সেই রূপান্তর বা ট্রেন্সজেন্ডারের ঘটনা নিয়ে তখন কেউ কোথাও কোনো ঘৃণা উগড়ে দিয়েছে বলে শোনা যায়নি। মাদ্রাসা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো মোল্লা একে ঘৃণ্য কাজ বলে সমালোচনা করেনি। অবশ্য মাদ্রাসায় তখন মোল্লারা থাকলেও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তা ছিলো একেবারেই দুর্লভ। অর্থাৎ বর্তমানের এই ঘৃণাজীবী জেনারেশনের তখনও জন্ম হয়নি। ছবির এই মানুষটিই এক সময়ের আব্দুস সামাদ এবং বর্তমানের হোসনে আরা বেগম। না, তিনি হেলাফেলারও কেউ নন একজন শিক্ষাবিদ এবং সফল উদ্যক্তা তিনি। বগুড়া সরকারি কলেজ, মহিবুর রহমান মহিলা কলেজ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ ও জয়পুরহাট সরকারি মহিলা কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৮০ সালে তিনি নিজ শহর বগুড়াতে ১২৬ জন ভিক্ষুকের মুষ্টি সংগ্রহের ২০৬ মন চাউল নিয়ে দেশের একটি শীর্ষ এনজিও প্রতিষ্ঠান ‘ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ (টিএমএসএস) গোড়াপত্তন করেন। এই সংগঠনের সম্পদের পরিমাণ এখন ঈর্ষণীয়। টি এম এস এস মেডিকেল কলেজ, রফাতুল্লাহ কম্যুনিটি হাসপাতাল, ফাইভ স্টার মম ইন হোটেল, দুটি সি ইন জি স্টেশন, তিনটি পেট্রল পাম্প, বহুতল ফ্ল্যাট ভিত্তিক রিয়েল এস্টেট ব্যবসার মালিক এই সংগঠন। শিক্ষা স্বাস্থ্য ও মাইক্রো ফাইন্যান্সের মাধ্যমে পঞ্চাশ লাখ মানুষ এই সংগঠন থেকে উপকৃত হয়েছে। এখান থেকে একজন উদ্যোক্তা সর্বোচ্চ ২০ লক্ষ টাকা ঋণ নিতে পারেন। দেশের ৬৪টি জেলাতেই এম এস এস এর শাখা রয়েছে। এদের অফিস কর্মচারীর সংখ্যা ৩২০০০। দেশের ছোট বড় একলাখ ১২ হাজার সমিতি টি এম এস এস এর আওতাভুক্ত।
হোসনে আরা তাঁর এই অসামান্য কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ‘অশোকা ফেলোশিপ’ এবং বেগম রোকেয়া পদক অর্জন করেন। হোসনে আরা এবং অধ্যাপক আনসার আলী তালুকদার দম্পতির এম আলী হায়দার নামক এক সন্তান রয়েছেন। এবার বলুন ভার্সিটি পড়া সেই যুবক আব্দুস সামাদ সেদিন যদি তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত বিচক্ষণ সিদ্ধান্তটি না নিতেন, যদি সেই নমস্য চিকিৎসক তাঁর সার্জারিটি না করতেন, যদি আব্দুস সামাদ তার পরিবর্তনের কথা সহপাঠীদের সঙ্গে শেয়ার করতেন (অবশ্য শেয়ার না করলেও চাল চলন ও কথাবার্তার ধরন থেকেই তা প্রকাশিত হয়ে যেতো) ফলাফল কী হতো? সহপাঠীদের ঠাট্টা মশকরা বুলিংয়ের শিকার হয়ে ক্ষোভ লজ্জা ঘৃণায় হয়তো তাঁকে একদিন হিজড়াদের ঢেঁড়ায় গিয়ে উঠতে হতো এবং আজও হয়তো তিনি হিজড়াদের মাসি হয়ে ঢেঁড়ায় বসে জীবন কাটাতেন। তাহলে জাতি কি পেতো পঞ্চাশ লাখ মানুষের ভাগ্য বদলানোর এই মহান ব্যক্তিকে? আমাদের চোখের সামনে আকাশ ছোঁয়া সফলতায় ভাস্বর একজন ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত থাকার পরও যদি আমাদের চোখ না খুলে তাহলে বলতে হবে আমরা আসলেই একটি ব্যর্থ জাতি। এই ব্যর্থতার দায় আমাদের সরকারগুলোর, কারণ পঞ্চাশ বছরেও তারা বিবেক সহমর্মিতা আর বোধবুদ্ধিসম্পন্ন একটি মানবিক প্রজন্ম তৈরি করতে পারেনি। মাত্র পয়তাল্লিশ পঞ্চাশ বছর পূর্বে যে রূপান্তরকে সমাজ সাদরে গ্রহণ করেছে আজ সেই রূপান্তরকে ভাবা হচ্ছে অপরাধ হিসেবে। কী বিপুল পতন আমাদের! রাস্তাঘাট, ব্রীজ, কালভার্টের উন্নয়নই উন্নয়ন নয় মানবিক উন্নয়নটিই আসল উন্নয়ন এবং তা তৈরি করতে আমরা একশত ভাগ ব্যর্থ হয়েছি। ফেসবুক থেকে