শিরোনাম
◈ এপ্রিলে  ১০১ কোটি ৩৮ লাখ টাকার চোরাচালান পণ্যসামগ্রী জব্দ করেছে বিজিবি ◈ ঐক্যবদ্ধ শাহবাগ বিএনপির অপেক্ষায়: সারজিস আলম ◈ জনআকাঙ্খা ও রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের বিষয়ে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জনতা পার্টি বাংলাদেশের ◈ ভারত-পাকিস্তান তৃতীয় দিনের মতো সংঘর্ষে জড়ালো, যুদ্ধাবস্থা সীমান্তজুড়ে ◈ 'আপ বাংলাদেশ' নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ◈ দেশে অনলাইন জুয়া সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে: অনলাইনে জুয়া বন্ধে কঠোর হচ্ছে সরকার ◈ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে শাহবাগ অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ (ভিডিও) ◈ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে শাহবাগ মোড় অবরোধের ডাক হাসনাতের (ভিডিও) ◈ নারায়ণগঞ্জ থেকে কাশিমপুর কারাগারে আইভী ◈ ‘মিথ্যাচার ও আক্রমণাত্মক বক্তব্যের’ জবাব দিলেন আসিফ নজরুল

প্রকাশিত : ০৪ অক্টোবর, ২০২৩, ১২:৩৪ রাত
আপডেট : ০৪ অক্টোবর, ২০২৩, ১২:৩৪ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

জাপানের রিসাইকল সমাচার

প্রবির বিকাশ সরকার

প্রবির বিকাশ সরকার: জাপানে শিনবুন কাইশুউ, কোশি কাইশুউ নামে সামাজিক রীতি আছে। এই রীতি অনুযায়ী পুরনো পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন, গ্রন্থসহ যাবতীয় কাগুজে পণ্যসামগ্রী এবং হার্ডবোর্ড, অ্যালমুনিয়মের কেন, কাঁচের জিনিস ইত্যাদি সংগ্রহকে বোঝায়। এককথায় ‘গোমি’ বা ‘আবর্জনা’ সংগ্রহ। নগর দপ্তরের ময়লা-আবর্জনার গাড়ি এসে তুলে নেয় প্রতিদিন, এটা দাপ্তরিক কাজ। এর বাইরে শিশুদের ক্লাব, পরিবেশ সংরক্ষণসহ অনেক সংগঠন, সংস্থা উপর্যুক্ত ‘গোমি’ সংগ্রহ করে রিসাইকল সেন্টারে নিয়ে যায়। আবার অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আছেন যারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে পুরনো কাগজ, টিনের পাত্র, বৈদ্যুতিক পণ্যসামগ্রী নম: নম: পয়সার বিনিময়ে কিনে নিয়ে রিসাইকল সেন্টারে চড়া দামে বিক্রি করেন। কিছুদিন আগেও হোমলেস বুড়োরা সাইকেলে করে পথঘাটে পড়ে থাকা, উদ্যানের ডাস্টবিনে জমে থাকা, পাবলিক টয়লেটে রেখে যাওয়া বিয়ার, মদের, জুসের টিনের কেন সংগ্রহ করে রিসাইকল সেন্টারে বিক্রি করে একার জীবন নির্বাহ করতেন, এখন অবশ্য তাদেরকে দেখা যায় না, অন্তত আমার শহরে। 

আমি এই রীতির সঙ্গে প্রথম পরিচিত হই ১৯৯৫ সালের দিকে। ম্যানশনে বসবাস। নিয়মানুসারে পরিচালনা পরিষদ থেকে প্রতিবছর ‘শিনবুন কাইশুউ’ দল তৈরি করা হয়। বিশেষ করে, যে পরিবারে শিশুসন্তান আছে তাদেরকে অবশ্যই দলভুক্ত না হলে নয়। আমার মেয়ে টিনা তখন তিন বছরের, সুতরাং দলভুক্ত হতেই হবে। প্রতিমাসের শেষ শনিবার বা রোববারে ম্যানশনের ‘গোমিবেয়া’ বা আবর্জনা জমিয়ে রাখার নির্দিষ্ট ভাগাড় থেকে পুরনো কাগজ, ম্যাগাজিন, বই, প্রচারপত্র, ক্যাটালগ, ছবির অ্যালবাম, কাগজের নানা ধরনের হাতব্যাগ এবং পুরনো কাপড় বের করে ট্রাকে তুলে দিতে হতো। শিশুরাও মহোৎসাহে সহযোগিতা করতো। তখন রিসাইকল হতো শুধুমাত্র শিশু সংগঠনগুলোর জন্য। অর্থাৎ, রিসাকল সেন্টারে বিক্রিবাবদ টাকা শিশুদের কল্যাণে, নানা উৎসবে ব্যয় করা হতো। এখন অবশ্য শিশুহ্রাসের কারণে শিশুরা আর অংশগ্রহণ করে না। তবুও কোনো কোনো শহরে ও অঞ্চলে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এই কাজে অংশ নিচ্ছে। সেইসময় প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাই আগের দিন গাড়িতে চড়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে ‘কোচিরা ওয়া কোদোমো কাই দেসু। আশিতা ওয়া ফুরু শিনবুন কাইশুউ নো হি দেসু। মিনাসান, ফুরু শিনবুন অ ওমোতে নি দাশিতে কুদাসাই। ওনেগাইশিমাসু।’ অর্থাৎ, আমরা শিশু সংগঠন থেকে বলছি, আগামীকাল পুরনো পত্রিকা সংগ্রহের দিন। সবাই বাইরে জমা করে রাখুন, বলে ঘোষণা দিতো। এখন শোনা যায় না। 

যাহোক, দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর ধরে একাধিকবার ঘুরে ঘুরে আমি সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণ করে আসছি। এই বছরও ছিলাম। আজকে শেষ হলো আমাদের দলের দায়িত্ব, আবার ৩-৪ বছর দায়িত্ব নিতে হবে। জাপান বিশ্বের অন্যতম প্রধান শিল্পোন্নত এবং পণ্যপ্রস্তুতকারী রাষ্ট্র হওয়ার কারণে গোমি তথা ময়লা-আবর্জনার পরিমাণ অত্যন্ত বেশি। ১৩টি প্রতিষ্ঠান মোটর গাড়ি তৈরি করে। ডজনখানেক কোম্পানি বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম। খাদ্য-খাবার তৈরি করে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। শিশুদের খেলনা তৈরি করে না হলেও চারটি বড় প্রতিষ্ঠান। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্রান্ডের পণ্য জাপানের। প্রসাধনী তৈরির প্রতিষ্ঠানই রয়েছে কম হলেও ২০-২৫টি। ফ্যাশন পণ্যসামগ্রীর কথা আর না বললেও চলে। জাপানিদের মতো সৌন্দর্যপ্রিয়, ফ্যাশনঅন্তপ্রাণ জাতি আর দ্বিতীয়টি এই ধরায় আছে কিনা সন্দেহ। শতাধিক প্রকাশনালয়, বহুল প্রচারিত ৫টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা সকাল-বিকাল সংস্করণ প্রকাশ করে। রয়েছে কমপক্ষে ৩টি প্রচারবহুল সান্ধ্য টেবলয়েড। প্রায় ৪৮টি প্রদেশের দৈনিক পত্রিকা রয়েছে। অসংখ্য ম্যাগাজিন এবং বই। মানবজীবন ও প্রকৃতি-পরিবেশ-পশুপাখি-পাহাড়-সমুদ্র-কৃষিবিষয়ক ম্যাগাজিন, পত্রিকা এবং গ্রন্থ অগণন। শিশু পিকচার বুক, শিশুদৈনিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক, মাসিক ম্যাগাজিন, মানগা/কমিক্স বই, ম্যাগাজিনের সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। এসব তো পাঠ করার পর পুরনো হয়ে যায়। পুরনো হলেই তো গোমি। গোমি এখন অত্যন্ত মূল্যবান। প্রাণী ছাড়া কৃত্রিম সবকিছুই রিসাইকল হচ্ছে জাপানে। কারণ এইসব অতিমূল্যবান ‘শিগেন’ মানে জবংড়ঁৎপব অর্থাৎ সম্পদ। 

সরকারের বিগত দিনের প্রচেষ্টায় সাধারণ নাগরিকরা বুঝতে পেরেছেন গোমি মানেই মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ যা দিয়ে নতুন নতুন ব্যবহার্য জিনিস, পণ্যসামগ্রী, কাগজ, কাপড়, টিনের পাত্র, কাঁচের পাত্র তৈরি সম্ভব। এবং তাই হচ্ছে বিগত ৩০ বছর ধরে। মানুষ যতো সচেতন হচ্ছে ততোই রিসাইকল প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, সর্বত্র বৃদ্ধি পাচ্ছে। গোমিও হ্রাস পাচ্ছে। পরিবেশ পরিচ্ছন্ন, সুন্দর হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে ইন্টারনেটের কারণে প্রকাশনা হ্রাস পাচ্ছে। তারপরেও ২০১৯ সালে পুরনো কাগজের সংগ্রহ ছিল ৭৯.৫% এবং পুরনো কাগজের রিসাইকল হয়েছে শতকরা ৬৪.৪ %। বিদেশে পুরনো কাগজ রপ্তানি করা হয়েছে ৩১৪ টন। সূত্র: জাপান পেপার অ্যাসোসিয়েশন, ২০২০।  প্রকৃতপক্ষে, জাপানে রিসাইকলের ইতিহাস অনেক পুরনো, সেই হেইয়ান যুগে (৭৯৪-১১৮৫ সাল) শুরু। এই যুগে কাগজ ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল, ফলে নাগরিকরা যত্নের সঙ্গে পুরনো কাগজ ব্যবহার করতেন, যাকে বলা হতো ‘কোশি সুকি-কায়েশি’। 

মধ্যযুগে তথা এদো যুগে ( ১৬০৩-১৮৬৮ সাল) এসে পুরনো কাগজ সংগ্রহ করার ফেরিওয়ালা ছিলেন অসংখ্য। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরনো কাগজ সংগ্রহ করে বইয়ের দোকানে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করে দিতেন। পুরনো কাগজ মোড়ক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্ণাড্য মোড়ক সংস্কৃতি জাপানের আরেকটি অনন্য নান্দনিক শিল্প। এদো যুগে মানুষের বিষ্ঠা ও প্রস্রাবও ব্যবসার পণ্য হিসেবে ছিল। ভাঁড় কাঁধে নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেসব সংগ্রহ করতেন এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী। কৃষকদের কাছে বিক্রি করে দিতেন, তারা সেসব সার হিসেবে ক্ষেতেখামারে ব্যবহার করতেন। এই যুগের রিসাইকল সচেতনতা অত্যন্ত অগ্রসর ছিল। তারই ঐতিহ্য ধরে এখন প্রযুক্তির সাহায্যে বৈচিত্র্যময় রিসাকল প্রকল্প বর্ণিল উৎসব, মেলায় পরিণত হয়েছে। সেইসঙ্গে দিন দিন কঠোর হচ্ছে জাপানের রিসাইকল সিস্টেম। প্রাকৃতিক সম্পদহীন জাপান রিসাইকল প্রকল্পের জন্য এক অনুসরণীয় উদাহরণ বাংলাদেশের জন্য। লেখক ও গবেষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়