অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল): ক্যান্সার এমন একটি রোগ যে অঙ্গে এটি হয় সে অঙ্গটির কোষগুলো অনির্দিষ্টভাবে বাড়তে শুরু করে। একটা পর্যায়ে সেই কোষগুলো টিউমারের আকার ধারণ করে। এটা তখন অঙ্গের সমস্ত পুষ্টিকে নিজে শুষে নেয় এবং তার কার্যক্ষমতা নষ্ট করে। একসময় সারা শরীরে একই রকম সমস্যা তৈরি করে। যখন যে অঙ্গে ক্যান্সার তৈরি হয়, তখন সেটাকে সেই নামে ডাকা হয়। যেমন লিভারে যদি ক্যান্সার হয়, তাহলে তা লিভার ক্যান্সার, ফুসফুসে যদি ক্যান্সার হয়, তাহলে আমরা বলি ফুসফুসে ক্যান্সার। লিভারে ক্যান্সার হলে যেমন লিভারের কোষগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে। ফলে টিউমার দেখা দেয় এক বা একাধিক তখন সেই টিউমারগুলোর ফলে লিভারের ফাংশনগুলোর একটা সঠিকভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়। ফলে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লিভার আর ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। ক্যান্সার লিভারের বাইরে ছড়িয়ে পড়লে সেটি নানা জায়গায় ছাড়িয়ে পড়তে পারে।
লিভারের ক্যান্সারের কতোগুলো কারণ আছে। এখন আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যে কমন কারণ যেটা লিভারের ক্যান্সারের সময় আমরা দেখি, হেপাটাইটিস বি-ভাইরাসের ইনফেকশন। ফ্যাটি লিভার হচ্ছে ক্যান্সারের একটি বড় কারণ। সি-ভাইরাসের ইনফেকশন থেকে লিভারে ক্যান্সার হয়। একটা সময় ছিলো যখন আমরা অনেক বেশি লিভারের সি ভাইরাসের ক্যান্সার দেখতাম। কিন্তু ধীরে ধীরে ফ্যাটি লিভার সেই জায়গাটা দখল করে নিয়েছে। এখন সি-ভাইরাসের ক্যান্সারের চেয়ে বাংলাদেশে ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা বেশি। তবে এখনো বি ভাইরাসটি সবার উপরেই আছে। তবে ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, সামনে হয়তো আমরা অনেক বেশি এ ধরনের ক্যান্সারের রোগী দেখবো এবং একসময় ক্যান্সারের প্রধান কারণ হিসেবে বাংলাদেশে বি-ভাইরাসকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। আরও কিছু কারণে আমরা ক্যান্সার দেখতে পাই, যার মধ্যে যেমন অ্যালকোহল বা মদ্যপানের কারণে মানুষ। কিন্তু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে। সুতরাং এগুলোই হচ্ছে বাংলাদেশে লিভারের ক্যান্সারের প্রধান কারণ। তবে কোথায় কোনটা প্রধান কারণ সেটা একেক দেশে একেক রকম। তবে গোটা বিশ্ব জুড়েই ফ্যাটি লিভার এখন মোটামোটি ক্যান্সারের প্রধান কারণ।
তামাক ক্যান্সারের সঙ্গে অনেক বেশি জড়িত। আপনি যে তামাক গ্রহণ করছেন বা অ্যালকহল গ্রহণ করছেন এগুলোর সঙ্গে লিভার ক্যান্সার খুব ঘনিষ্টভাবে জড়িত কিন্তু এখনো পর্যন্ত তামাক ক্যান্সারের প্রধান কারণ নয়। ফুসফুস ক্যান্সারের প্রধান কারণ হচ্ছে তামাক আর লিভার ক্যান্সারের প্রধান কারণ হচ্ছে হেপাটাইটিস বি-ভাইরাস বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। ডায়বেটিস থেকে লিভারে ক্যান্সার হয়ে যেতে পারে আবার অনেক সময় বি-ভাইরাস বা সি-ভাইরাস আমাদের শরীরে বাসা বাধে এবং আমাদের লিভারকে ডেমেজ করতে থাকে আমরা তা বুঝতেও পারি না। লিভারের রোগীর একটা বড় অসুবিধা হচ্ছে আমাদের লিভার যে নষ্ট হচ্ছে আমরা তা বুঝতেও পারি না। মানুষ সহজে টের পায় না টেস্ট না করা পর্যন্ত। এমন অনেক মানুষ আছে যাদের লিভার সিরোসিস পর্যন্ত চলে যায় কিন্তু রোগী টেরও পাচ্ছে না। কারণ কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।
হেপাটাইটিস বি-ভাইরাস এবং সি-ভাইরাস হওয়ার কোনো বয়স নেই। কারণ দুটোই রক্তবাহিত ভাইরাস এবং যে কোনো বয়সের মানুষই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। সি-ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ১০ থেকে ১৫ বছর লাগে লিভার সিরোসিস পর্যন্ত পৌঁছাতে। বাংলাদেশে অনেকেই বি-ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। কারণ বাংলাদেশ হলো বি-ভাইরাসের মধ্যম মানের সংক্রমণের দেশ। কারণ বাংলাদেশের ৫ শতাংশ মানুষ বি-ভাইরাসের সক্রিয় রোগ বহন করেছে। আর প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ তাদের জীবনদ্দশায় বি-ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষের সবার উচিত বি-ভাইরাসের টিকা নিয়ে নেয়া। বিশেষ করে যাদের পরিবারে বি-ভাইরাসের রোগী আছে। আমাদের সবাইকে স্বাস্থ’্য সচেতন হতে হবে বিশেষ করে যারা মোটা মানুষ। যাদের ডায়বেটিস আছে, যারা হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত এই মানুষগুলোর আরও বেশি সচেতন হতে হবে।
পরিচিতি : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়। শ্রুতিলিখন : লাবিব হোসেন