শিরোনাম
◈ ভাতা তালিকায় যুক্ত হচ্ছে লাখো নতুন সুবিধাভোগী, বাদ পড়বেন অযোগ্যরা ◈ ইশরাককে মেয়র পদে বসানোর দাবিতে দ্বিতীয় দিনের মতো সড়কে অবস্থান (ভিডিও) ◈ লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলীতে অবস্থানরত বাংলাদে‌শিদের জন্য দূতাবাসের জরু‌রি বার্তা ◈ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ২০ হাজার কোটি ডলারে ১৬০ জেট কিনবে কাতার! ◈ আওয়ামী লীগ নির্বাচন থেকে বাদ পড়ায় কাদের সুবিধা হলাে ◈ মুস্তা‌ফিজ‌কে কি দেখা যাবে আইপিএলে? ক'টা ম্যাচ খেলবেন? ◈ স্প‌্যা‌নিশ লা লিগায় অনেক ক‌ষ্টে মায়োর্কাকে হারা‌লো রিয়াল মা‌দ্রিদ ◈ বাংলাদেশে নারী নির্যাতন : কক্সবাজার টু মুন্সিগঞ্জ ◈ হজযাত্রীদের লাগেজে অবৈধ মালামাল, ফের সতর্ক করল মন্ত্রণালয় ◈ বাংলা‌দেশ দল এখন আ‌মিরা‌তে, ‌টি - টো‌য়ে‌ন্টি সি‌রি‌জের প্রথম ম‌্যাচ ১৭ মে

প্রকাশিত : ২৩ জুন, ২০২৩, ০২:৪৬ রাত
আপডেট : ২৩ জুন, ২০২৩, ০২:৪৬ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: বাংলাদেশ আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্মলগ্নেই স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ রোপিত হয়েছিল। কারণ ’৪৭ থেকে ’৭১ পর্যন্ত স্বাধিকারের লাগাতার সংগ্রাম ও ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তবে তুলনামূলকভাবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ছিল প্রধান। সত্যি কথা বলতে কী, এই মানুষটি ছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দ্রষ্টা ও স্রষ্টা।

জন্মলগ্নের (২৩ জুন ১৯৪৯) আওয়ামী মুসলিম লীগ ছিল সাম্প্রদায়িক। কিন্তু দলটি একসময়ে অসাম্প্রদায়িক নাম ধারণ করে হলো আওয়ামী লীগ (২১ অক্টোবর ১৯৫৫)। জন্মলগ্নে দলটির নাম মওলানা ভাসানি বা শেখ মুজিবুর রহমান কারও পছন্দ ছিল না; কিন্তু সময় ও পরিস্থিতি বিবেচনায় তাঁরা নামটি গ্রহণ করেছিলেন। মূলত তাঁদের প্রচেষ্টাতেই একটি অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল হয়।

আওয়ামী লীগ বাঙালি স্বাধিকারকেন্দ্রিক দল হলেও বঙ্গবন্ধু দলটির জন্মের অনেক আগে থেকেই বাঙালি-মুক্তির স্বপ্ন রচনা করেছিলেন। ’৪৭ এর ১৬ আগস্ট কলকাতার ভবানিপুরে ইসলামিয়া কলেজের সিরাজউদ্দৌলা হোস্টেলে বঙ্গবন্ধু পূর্ব-বাংলার কিছু তরুণকে বললেন, ‘মিয়ারা ঢাকায় যাইবেন না। ওই মাউড়াদের সাথে বেশিদিন থাকা যাইব না। এখন থিকাই কাম শুরু করতে হইব।’ উপরন্তু বঙ্গবন্ধু বাঙালি-মুক্তির জন্য আওয়ামী লীগকে যথেষ্ট মনে করতেন না; কাজেই যুক্ত হয়েছিল তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগ। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রতিটি ক্রান্তিকালে বঙ্গবন্ধু তাঁর দলকে পাশ কাটিয়ে অগ্রসর হয়েছেন। ’৫৩-তে সাধারণ সম্পাদক হলেও ’৬০ এ তিনি গড়লেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ। সারা পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিমনস্ক তরুণরা ছিল প্রতিষ্ঠানটির চালিকাশক্তি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কারাবরণ করতে শুরু করলে প্রতিষ্ঠানটি গতিপথ হারায়। সামগ্রিক বিশ্লেষণে মনে হয়, বঙ্গবন্ধু দলের কার্যক্রমকে ব্যবহার করেছেন তাঁর একান্ত নিজস্ব প্রকল্প বাঙালি-মুক্তির লক্ষে এবং যা প্রমাণ করে লক্ষ্যাভিসারী বঙ্গবন্ধুর উদগ্র বাসনা।

’৬১-তে বঙ্গবন্ধুর এমন উদগ্র বাসনা সংক্রান্ত দুটো ঘটনা ঘটেছিল এবং তা দলের অজান্তেই। প্রথমটি ছিল পূর্ববঙ্গ মুক্তিফ্রন্ট নামে একান্ত নিজস্ব প্রকল্প চালু করা। নিজের মুসাবিদা করা ইংরেজিতে একটি প্রচারপত্র ছাপা হয় তাঁর নিজের অর্থে; যা তিনি সাইকেল চালিয়ে ঢাকার বিভিন্ন দূতাবাস/বিদেশি সংস্থায় বিলি করেন। প্রচারপত্রে ছিল বাঙালির অভিযোগ ও দাবি। দ্বিতীয় ঘটনাটি ছিল কমরেড মণি সিংহ ও কমরেড খোকা রায়ের সঙ্গে গোপন বৈঠক, যেখানে স্বাধীনতা/মুক্তির প্রশ্নে ঐকমত্য গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। এই বৈঠকের ফল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বামদলগুলো সমন্বিতভাবে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন শুরু করে।

১৯৬৩ সালে চুপিসারে বঙ্গবন্ধু আগরতলা যান এবং ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রি শচীন্দ্রলাল সিংহের শরণাপন্ন হন। বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্য ছিল নেতাজি সুভাষ বসুর অনুকরণে ভারতের সহায়তায় লন্ডন যাওয়া এবং সেখান থেকে বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনা করা। তবে মুখ্যমন্ত্রীর সুপারিশ সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী নেহরু সম্মত হলেন না। কারণ ছিল, ভারত-চীন যুদ্ধপরবর্তী ভারতের নাকাল অবস্থা। ফলে আবার গোপনে বঙ্গবন্ধু খালি হাতে ফিরে আসেন। 

’৬৫-র পাক-ভারত যুদ্ধে প্রমাণিত হয়, তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার নাজুক অবস্থা, যা প্রদেশে দারুণ রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা করতে হবে।’ এই নতুন চিন্তার ফসল ছিল ’৬৬ র ছয়দফা, যার সূচনায় আওয়ামী লীগের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। কাউন্সিল সভায় সভাপতি মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগিশ দ্বিমত পোষণ করে পদত্যাগ করেন। বঙ্গবন্ধু হন সভাপতি; আর সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ। লক্ষণীয়, মুক্তিযুদ্ধের আগে বঙ্গবন্ধু প্রায় চার বছরের মতো সভাপতি থাকার সময়ে (তিনি সভাপতিত্ব ছাড়েন ১৯৭৪ এ; ১৯৫৭-তেও তিনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলে ফিরেছেন। তিনি গণতান্ত্রিক রীতি মেনে কখনও দল ও সরকার একাকার করেননি) দ্বিতীয় এমনকি তৃতীয় সারির নেতা তৈরি করেছিলেন; যার ফলে জাতীয় চার নেতার পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। যাহোক, ছয় দফা ছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সামরিক স্বীয়তার (autonom) দাবি, যা আসলে ছিল ১৯৪৯ থেকে চলে আসা আওয়ামী লীগের দাবিসমূহের সমন্বিত রূপ; বঙ্গবন্ধু নতুন কোনো কথা বলেননি। উপরন্তু ছয় দফার কথাগুলো বঙ্গবন্ধু নতুন দিন পত্রিকায় লিখেছিলেন। ছয় দফার আন্দোলনকে বেগবান করেছিল ছাত্রলীগ (প্রতিষ্ঠা ৪ জানুয়ারি ১৯৪৮)।

ছয় দফা আন্দোলন থেকে বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য আইয়ুবের অনেক কৌশলের চূড়ান্ত রূপ ছিল, আগরতলা মামলা (১৯৬৮) (বঙ্গবন্ধু বলতেন ইসলামাবাদ ষড়যন্ত্র মামলা)। আগরতলা মামলাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শ্লোগান ছিল, ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো।’ ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করা হলো। শেখ মুজিবসহ অন্য বন্দিরা মুক্তি পেলেন। পরদিন রেসকোর্সে শেখ মুজিব হলেন বঙ্গবন্ধু। প্রস্তাবকারী ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ; চয়নকারী রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক (গত বছর প্রয়াত)।

৫ ডিসেম্বর ১৯৬৯, সোহরাওয়ার্দীর ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, পূর্ব-পাকিস্তানের নাম হবে বাংলাদেশ। আইয়ুবের স্থলাভিষিক্ত হন ইয়াহিয়া খান (২৫ মার্চ ১৯৬৯)। তাঁর ঘোষিত ১৯৭০-এর প্রথম জাতীয় নির্বাচনে গোল বাধলো আইনি কাঠামো (Legal Framework Order) নিয়ে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিপক্ষে ছিলেন; কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন দৃঢ়ভাবে পক্ষে। তাঁর কথা ছিল, ‘আমার লক্ষ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা। নির্বাচন হয়ে যাবার পর আমি এলএফও টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবো।’

আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বরাদ্দ ১৬৯টির এধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়ী হয়ে সারা পাকিস্তানে একক গরিষ্ঠ দল হলো (অন্য দুটি আসনে জয়ী হলেন নূরুল আমীন ও রাজা ত্রিদিব রায়)। নির্বাচনের তিনদিন আগে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিক এ্যান্থনী ম্যাসক্যারেনহাসকে এমন ফলাফলের কথা বলেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের ফল অনুযায়ী যা হবার কথা, তা হলো না; আওয়ামী লীগ ক্ষমতা পেলো না। ইয়াহিয়া-ভূট্টো সামরিক বাহিনির চক্রান্তে পাকিস্তানের রাজনীতি ঝুলে গেলো। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বলে দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এদিকে ১ মার্চ থেকে শুরু হয়ে ২৫ মার্চ পর্যন্ত চলেছিল এক দৃষ্টান্তরহিত অহিংস অসহযোগ আন্দোলন। ১৬ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ইয়াহিয়া ভুট্টোর সঙ্গে প্রহসনের সংলাপ করলো। প্রহসন এই কারণে যে, ইতোমধ্যে পাকিস্তানি সামরিক শক্তি বাড়ানো হলো; আর ২৫ মার্চ রাত সাড়ে দশটার শুরু হলো গণহত্যা, যার সাংকেতিক নাম ছিল, ‘অপারেশন সার্চলাইট।’ বাঙালি প্রতিরোধ করতে গিয়ে শুরু করলো মুক্তিযুদ্ধ, যার সমাপ্তি ঘটলো ১৬ ডিসেম্বর দখলদার পাকিস্তানি বাহিনির আত্মসমর্পনের মাধ্যমে।

ইতোমধ্যে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে রাত ১২:২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেসে রেকর্ড করলেন, ‘সম্ভবত এটাই আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ ১০ জানুয়ারি ১৯৭২, পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে ফিরে রেসকোর্সে ১৭ মিনিটের ভাষণের শুরুতেই বললেন, ‘আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে, আজ বাংলাদেশ স্বাধীন।’ বাংলাদেশ নিয়ে এমনভাবে কেউ তো আর বলেনি।

লেখক: চেয়ার অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চেয়ার, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়